শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

গল্পঃঅণুগল্প (অন্ধকার,আলো)/Anugolpo (ondhokar,alo)

 











অণুগল্প

 

অন্ধকার

 

খেজুরগাছের নিচে কীসের একটা আওয়াজ হল খড়মড় চারদিকে জমাট অন্ধকার কৃষ্ণপক্ষ চলছে স্বদেশ  টর্চটা জ্বালাল দেখতে পেল না কিছুই তবু সাবধান হল সিতুদের বাড়ির পুরো রাস্তা টর্চটা জ্বালিয়েই রাখল

-মামিমা! সিতুদের ঊঠানে এসেই হাঁকল স্বদেশ

-সোদেশ আইসস নাকি?আয় আয়  

 -আজ কী অন্ধকার মামিমা! আর আপনাদের রাস্তাটাও খুব জঙ্গলে ভরে গেছে

-তোর মামা তো লুক খুঁজতাসে কাটনের লেইগ্যা আজকাল লুক মেলাই দুষ্কর পূজা আইতাসে ঝুপঝাড় একটু না কাটলে পোলাপানেরা রাইতে ঠাকুর দেখতে বাইর হইব কুন সাহসে!

সিতু ইত্যবসরে চা বানিয়ে হাজির–স্বদেশদা চা

-আবার চা করলি কেন? -লবানকে দেখছি না! স্বদেশ তাকাল এদিক সেদিক

-লবানরে একটু দুকানে পাঠাইসি তেল আনতেএই সিতু একটু যা তো হ্যারিকেনডা লইয়া অন্ধকারে নিমগাছটার তলে ও খুব ভয় পায় আগাইয়া দ্যাখ তো!

-সিতু বস আমি যাচ্ছি নিয়ে আসছি লবানকে মামিমা, মামাও তো ফেরেনি টর্চ থাকে মামার কাছে?

-টর্চ তো পকেটেই থাকে কিন্তু যা বেহুঁশ লুক,জ্বালাইব নাকি রাস্তায়! অন্ধকারেই গটমট কইরা চইল্যা  আইব

হঠাৎ দুম আওয়াজ হ্যারিকেনের কাচ ফাটলকাইল আনসি নতুন কাচ মন লইতাসে কাচডা লইয়া এক্ষুনি সুখেনের মুখে ছুইড়া মারি কুন হান থেইক্যা এইসব কাচ হে আমদানি করতাসে কে জানে!

সিতু ঘরের বিছানার তলা থেকে  একটা পোস্টকার্ড নিয়ে আসে দু টুকরো করে এক টুকরো কাচে আটকে দেয়

মা! উঠোনে লবানের গলাএই নাও তেলবাবাঃ,কী অন্ধকার! আসাই যায় না টর্চটাও জ্বলছে না ঠিকমত কী ভয় যে লাগছিল!

-সিতু এবার যখন সুখেনের দোকান থেকে হ্যারিকেনের কাচ আনবি ,এনেই কী করবি বল তো? এনে কিছুক্ষণ গরম জলে ডুবিয়ে রাখবি আমরা ভাল ফল পেয়েছি

-‘আচ্ছা স্বদেশদা,শহরের মত বিজলি আলো আমাদের এ গ্রামে কি কখনও আসবে?

-হয়ত আসবে দশ,কুড়ি বা তিরিশ বছর পর। ততদিনে-

-ততদিনে আমরার কাল শেষ হইয়া যাইব

-হয়ত তাই কিন্তু মামিমা আমি ভাবছি অন্যকথা গ্রামে বিজলি এলে শহরের মত আমাদের এমন রাতটাও তো হারিয়ে যাবে এই অন্ধকার,নিমতলা,ভয়,মাটির দাওয়ায় বসে আধো অন্ধকারে এই আমাদের গল্প করা,তারপর রান্নাঘরে কূপি জ্বেলে আর কদিন বাদে আপনার পুজোর নাড়ু করা, কী হবে সেসবের! বিজলির আলোর গল্প হয়ত আলাদা হবে, কারণ বিজিলির আলোয় অন্ধকারের এই সব গল্প জমবে না।

-সোদেশের কথা শুনলে হাসি পায়। কী একটা গল্প আসিল না,সিতুরা পড়সে,ওই যে ক’ না,শিয়ালে আঙ্গুর  ফল খাইতে গিয়া,লাফাইয়া পাড়তে পারে নাই,তখন কী যেন কইয়া চইল্যা গেল-

-আঙুর ফল টক। লবান ঘর থেকে জবাব দেয়।

স্বদেশ হাসে।-সে আপনি যাই বলেন মামিমা, বিজলি এলে তারাভরা আকাশ,পূর্ণিমার চাঁদ সব ঢাকা পড়ে যাবে।

-ওইসব দিয়া কী হইব সোদেশ ? আজ দেখসস কী গরম পড়সে,গাছের একটা পাতাও নড়তাসে না। বিজলি আইলে তো পাখার বাতাস খাইয়া বাঁচতাম।

 লবান পুরোপুরি মার দিকে। কিন্তু সিতু বুঝতে পারে না,সে কোন দিকে যাবে। আলোর দিকে না অন্ধকা্রের দিকে? বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক হয়েছে। শহরে ফ্ল্যাট। সুচাকুরে। সব দিক থেকেই আলো। কিন্তু সিতুর কি সামনের অন্ধকারটা ফেলে সে-আলো সহ্য হবে? ভালও কি লাগবে?

 

চল্লিশ বছর পরে আর এক গল্প

 

আলো

 

বিপদ একা আসে না। ঝড়ে আজ কাচ ভাঙল জানলার। আর তারপরেই বাজ পড়ে নষ্ট হয়ে গেল নতুন টিভিখানা। ঝড়বৃষ্টি কমলে শুরু হলে খোকনের পেটে যন্ত্রণা। ওষুধ নিয়ে সিতু ওঘর থেক আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল। ওপড়াল বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ।

কীভাবে কোনটা সামলাবে ভেবে পেল না দুজনে। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। এ অবস্থায় কে খুলবে দরজা! পেটে হাত দিয়ে স্বদেশই গেল। বিদ্যুৎ অফিসের লোক। বিল নিয়ে এসেছে। তিনমাসের বিল।

 বিলের অঙ্ক দেখে স্বদেশের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বিলটাকে ফ্রিজের উপর চালান করে,ওষুধের বাক্সটা বের করল। ওষুধ খেল। সিতুর পায়ের বুড়ো আঙুলে লাল ওষুধ দিয়ে ন্যাকড়া জড়িয়ে দিল।

-বিল কত এলো গো?

-সাত হাজার তিনশো পঁয়ত্রিশ।

-কীভাবে দেবে? অপুকে কি বলব?

-না থাক। যে ছেলে সেভাবে খোঁজই নেয় না বাবা মায়ের,তাকে আর-

-তা ঠিক। কিন্তু-তোমার চাকরি থাকলে তো আর- করোনা সব খেয়ে গেল! সিতুর গলা বুজে এল   কান্নায়।

বিদ্যুৎ বিল না দিতে পারায় একদিন লাইন কাটা পড়ল স্বদেশদের।  

অন্ধকারে ব্যালকনিতে সেদিন বসে রয়েছে দুজনে । হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা ধরতে গিয়ে কেঁপে উঠল স্বদেশ। -কে ফোন করেছে গো?

জবাব দিল না  স্বদেশ।

সিতু শুনল স্বদেশ ফোনে বলছে-ভালো আছি আমরা। তোরা কেমন আছিস?-না,না চিন্তা করার দরকার নেই।-ও জিম,জিম চাঁদ দেখছে ছাদে উঠে? জিমকে বলিস ওর দাদু ঠাকুমাও ব্যালকনিতে বসে চাঁদ দেখছে। পূর্ণিমা,খুব বড় চাঁদ উঠেছে আজ। খুব বড়…  

 

-

 

 

 

 

বুধবার, ১২ আগস্ট, ২০২০

কথাঃ গরুর গাড়ির ক'টি চাকা

কথা

গরুর গাড়ির ক'টি চাকা






























আলাপনের বিয়েতে বরযাত্রী যাচ্ছি। পিচঢালা মসৃন রাস্তা। চারচাকা এসিতে আলাপন। পাশে আমরা ক'জন।

-'আমার বিয়েতে সবাই গিয়েছিলাম বাসে।'  কিছুটা যেতেই বললেন এক বয়স্ক সহকর্মী।

সমবয়সী সহকর্মী বন্ধু  তমাল এক বয়স্ক সহযাত্রীকে শুধোল-'কাকু আপনিও কি বাসে গিয়েছিলেন বিয়ে করতে?'
 
বরবেশী আলাপন রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল-'কাকুর বিয়ের গাড়ির কথা শুধোচ্ছিস? আমি জানি। বাবার মুখে শোনা। কাকু বিয়ে করতে গিয়েছিল দশচাকার গাড়িতে।'

-'দশচাকার গাড়ি!' তমাল শহুরে ছেলে,বুঝতে না পেরে তাকাল আলাপনের দিকে।

আমি হেসে বললাম-'দশচাকার গাড়ি মানে হল গরুর গাড়ি।'

দশচাকার গাড়ির রসিকতা  তমাল বোঝেনি।   এখনকার শহুরে ছেলেরা তো আরও বুঝবে না!  গ্রামের ছেলেরাও কি বুঝবে?

 সেদিন গ্রামের বাড়িতে শরৎচন্দ্রের মেজদিদি দেখছিলাম টিভিতে। সেই কাননদেবীর করা মেজদিদি নয়। একালের অভিনেতা অভিনেত্রীদের করা 'মেজদিদি'।

ছবির প্রায় শেষদিকে মেজদিদি গরুর গাড়ি করে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছেন,এমন সময় কাজের মেয়ে চুমকি তার ছোট ভাই গোপালকে আঙুল দেখিয়ে বলল-'দ্যাখ দ্যাখ অ-আ বইয়ের গরুর গাড়ি।' 

চমকে উঠলাম। জায়গাটা তো গ্রামই। আর চুমকিরা যেখানে থাকে সেটা আরও গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা হয়ে চুমকিদের গরুর গাড়ি দেখার দৌড় এখন তা হলে অ-আ বই আর সিনেমা! গরুর গাড়ি গ্রামদেশেও এতটা দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে বুঝিনি তো!

বড় রাস্তার ধারে বাল্যবন্ধু অশোকের চালের দোকান। গ্রামে গেলে,বিকেলে ওখানে কিছুক্ষণ বসি। সেদিন অশোককেই শুধোলাম-'গ্রামে এখন কারও বাড়ি গরুর গাড়ি আছে রে?'

উত্তরে যতটা ভেবেছিলাম,অশোক তার চাইতেও খারাপ খবর দিল। ওর কথায়,আমাদের গ্রাম তো বটেই, আশেপাশের গ্রামেও কারও বাড়িতে এখন গরুর গাড়ির দেখা পাওয়া যাবে না।

গরুর গাড়ির প্রয়োজন তাহলে ফুরিয়েছে! অশোক বলল-'গ্রামের  পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক ওলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছে ভ্যান রিকশা। এর সুবিধা অনেক। যেখানে সেখানে ঢুকতে পারে,খরচ কম,উপরন্তু দ্রুতগামী। অন্যদিকে গরুর গাড়ির অসুবিধা নানা ধরণের। গরু চাই,গাড়োয়ান চাই। আবার এগুলো দিয়েও এই দ্রুতগামিতার যুগে বরণ করে নিতে হবে মান্ধাতা আমলের শ্লথগতি। এ আবার হয় নাকি!'

বাড়ির পাশেই কুমোরবাড়ি। এতদিন খেয়াল করিনি। এবার দেখলাম,রবীন্দ্রনাথ কুমোরপাড়া থেকে বংশীবদন আর ভাগ্নে মদনকে দিয়ে সেই যে গরুর গাড়ি খানাকে যুগ যুগ ধরে বের করে আনছেন সেই জায়গাতেও কামড় বসিয়েছে ভ্যানরিকশা। দেখলাম, এই ভ্যান রিকশায় বাঁশের বাখারি দিয়ে কাঠের পাটাতনখানাকে  চারদিক বরাবর ঘিরে হাঁড়ি-কলসি রাখার বেশ সুবন্দোবস্ত রয়েছে।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। গরুর গাড়ি চলার ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ সেই সুদূর অতীত থেকে ভেসে আসছে। শুধু বাস্তবের নয়,বইয়ের পাতারও। কত গল্প উপন্যাসেরই না সার্থক অনুষঙ্গ হিসাবে এসেছে গরুর গাড়ি! 

মনে করা যাক 'পথের পাঁচালী'র সেই দৃশ্যটা, যেখানে মা ও বাবার সঙ্গে অপু চিরকালের মতো নিশ্চিন্দিপুরের সীমানা পেরোচ্ছে হীরু গাড়োয়ানের গরুর গাড়ি চেপে। গরুর গাড়ির জায়গায় অপুদের যাত্রা যদি ভ্যান রিকশায় হত তবে চিত্রটা এত নিখুঁত হত কি? নিশ্চিন্দিপুরের ক্রম-অপসৃয়মানতার জরুরি আবহসঙ্গীতটি গরুর গাড়ি ছাড়া আর কোন যান রচনা করতে পারত!

গতির যুগ এটা। গরুর গাড়ির তো হারিয়ে যাওয়ারই কথা। অথচ এককালে যান বলতে ছিল গরুর গাড়িই। মালপত্র বহন তো বটেই,এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম যাওয়া,এমনকী দূরপাল্লার যাত্রাতেও অনেক সময় গরুর গাড়ির সাহায্য নেওয়া হত।

 শোনা যায়,১৮৭৮ সালে,স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবেনেশ্বরী দেবী,ভাষাবিদ হরিনাথ দের মা এলোকেশীদেবীর সঙ্গে চব্বিশ পরগনা থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন এই গরুর গাড়িতেই। তাঁদের কর্তারা তখন ওখানকার বড় চাকুরে। গরুর গাড়িতে ওই দীর্ঘ পথযাত্রায়  বালক হরিনাথ ও বিবেকানন্দ (তখন নরেন্দ্রনাথ) সঙ্গীও হয়েছিলেন।

গরুর গাড়িতে দীর্ঘযাত্রার আরও উদাহরণ আছে। রামতনু লাহিড়ীর নিরুদ্দিষ্ট দাদা দ্বারকানাথ লাহিড়ীর সন্ধান পেয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে রামতনুর মা কৃষ্ণনগর থেকে আগ্রা গিয়েছিলেন গরুর গাড়ি চেপে।

অশোকের দোকানে বসে এসব ভাবছিলাম। আর মনে হচ্ছিল,একে একে গ্রামজীবনের কত অনুষঙ্গই না হারিয়ে গেল! আমাদের ঢেঁকি গিয়েছে। কলুটানা ঘানি ইতিহাসের পাতায়। তালপাতার ছাতা তো এখন প্রাগৈতিহাসিক জিনিস,কাউকে বিশ্বাসই করানো যাবে না এরকম একটা আশ্চর্য জিনিস একসময় দেখা যেত গাঁ-গেরামে।
 
গরুর গাড়িও  নিঃশব্দে এই চলে যাওয়াদের মহামিছিলে যোগ দিয়েছে ।

সেদিন কাগজ পড়ছিলাম, আর পাশে বসে স্কুলের কাজ সারছিল ছেলে। ওর অঙ্ক বইয়ের চৌকো ঘরে  ইংরেজি সংখ্যায় লিখতে  হবে বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর। প্রথম প্রশ্ন, গরুর কটি পা। সেটা লিখেই ছেলে দাঁড়িয়ে গেল দ্বিতীয় প্রশ্নে। কারণ দ্বিতীয় প্রশ্নটা বেশ কঠিন। রসিকতা নয়, সঠিক উত্তরটাই বসাতে হবে। ছেলে রুল মুখে নিয়ে চিন্তিত। কী হল? ছেলে জিজ্ঞেস করল,  'গরুর গাড়ির কটি  চাকা ‌বাবা?'




























সোমবার, ১০ আগস্ট, ২০২০

চল পানসিঃইতিহাসের স্পর্শ পেতে নালন্দায় (ethihaser sporsho pete nalanday)









 চল পানসি





ইতিহাসের স্পর্শ পেতে নালন্দায়




ছোটবেলায় বাড়ির বড়দের কাছে রাজা-রাজড়ার গল্প শুনে সেই যে ইতিহাস পিছু নিয়েছে আজও তার হাত থেকে ছাড়া পাইনি। কথাটা এভাবে বললাম ঠিকই,কিন্তু এটা আসলে ব্যাজস্তুতি। কেননা,ইতিহাসকে বার বার স্পর্শ করে আমি আনন্দিতই হই না ধন্যও হই।

ইতিহাস ঘিরে এই মুগ্ধতা আমাকে সেবার হাজির করল নালন্দায়। ডিসেম্বরের শেষদিক। তবু ততখানি ঠান্ডা নেই বিহারে। ঘোরার পক্ষে যা বেশ সুবিধাজনকই মনে হল।

আমাদের ছ'জনের দল। হাওড়া থেকে দুন এক্সপ্রেসে প্রথমে গয়া তারপর সেখান থেকে রাজগীর ঘুরে অবশেষে এসে পৌঁছলাম নালন্দায়। তখনও রাজগীর অবশ্য আমরা ত্যাগ করিনি। ঠিক হয়েছে,নালন্দা ঘুরে আবার ফিরব রাজগীরেই। তারপর সেখান থেকে আবার বাড়ির দিকে,বাসে।

রাজগীর থেকে নালন্দা পনেরো কিমি দূরত্ব। কন্ডাক্টেড ট্যুরের বাস রয়েছে। আমরা স্বাধীনভাবে ঘুরতে চাই। তাই ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম।

ভেবেছিলাম নালন্দা দু'তিন ঘন্টায় দেখে নিয়ে আশেপাশের আরও কিছু জায়গা ঘুরে নেব। কিন্তু নালন্দায় গিয়ে একেবারে মজে গেলাম, টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতেই এক প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় তার হারানো ঐশ্বর্যের স্মৃতি দিয়ে অবশ করে ফেলল। 

আমাদের গাইড নালন্দা নিয়ে বই লিখেছেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল একদা দশ হাজার ছাত্র এবং দু'হাজার শিক্ষকের আবাসিক এই শিক্ষামন্দিরের সুনাম শুধু দেশে নয়,দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

চিন,তিব্বত এইসব জায়গা থেকে বহু ছাত্র এখানে পড়তে আসত। হিউয়েন সাঙ এখানে দু'বছর ছিলেন। আর এক পরিব্রাজক ইৎসিং নাকি এখানে দশ বছর থেকে বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করেন।

ধর্ম,দর্শন,জ্ঞান,বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এখানে পড়ানো হত। গাইডের কথা শুনতে শুনতে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম প্রাচীন সেই বিদ্যামন্দিরের রূপ। এখনকার ছাত্র-কলরব মুখরিত শিক্ষানিকেতনের সঙ্গে তার মিল না থাকারই কথা।

ছাত্রদের থাকার ঘর গুলোয় ঢুকে যেন শিহরণ খেলে গেল। সঙ্গীরা একটু অন্যদিকে যেতেই একা একটা ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সন্তর্পণে ঘরে শয়নের জন্য নির্দিষ্ট উচ্চস্থানে গিয়ে বসলাম। নিজেকে মনে হল,'ক্ষুধিত পাষাণে'র সেই গল্প কথক। মনে হল,দেহহীন দ্রুতপদে কে যেন চলে গেল আর যাবার সময় শব্দহীন উচ্চারণে বলে গেল-'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।' 

কোনও এক পূর্বজন্মে আমিও কি এসেছিলাম এখানে? ওই যে প্রশস্ত আঙিনা যেখানে বসে ছাত্রেরা নিত ধাতুবিদ্যার পাঠ,হয়ত ওখানে আমিও একসময় বসেছি নিয়মিত। নিজের হাতে  তৈরি করেছি  ধাতু পাত্র।

-'চলো ওদিকটাতে যাই!' সঙ্গীর ডাকে সম্বিত ফেরে। টাল খাই। মনে হয় যেন হাজার -বারশো বছরের একটা ঘুম অকষ্মাৎ টুটে গেল। মুহূর্তের জন্য হলেও ভীষণ রিক্ত লাগল নিজেকে।

গাইডের মুখে শোনা গেল,গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তের সময়ে নালন্দার যাত্রা শুরু। একশোটির বেশি গ্রামের রাজস্ব দিয়ে চলত এর বিরাট খরচ। পরবর্তীকালে হর্ষবর্ধন,পাল রাজারা এগিয়ে এসেছিলেন নালন্দার সাহায্যার্থে। তাঁদের আমলে  এর সম্প্রসারণ, সংস্কারও হয়। পাল যুগের শেষ থেকেই শুরু হয় নালন্দার অবরোহন। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে এই শিক্ষায়তনের গৌরবময় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটে।

পুরো চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এর বিস্তৃতি। জানা গেল্‌ ১৪ হেক্টর জমি জুড়ে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। খনন কার্যের ফলে এগারোটি মঠ,ছ'টি বড় মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। 

প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে রয়েছে নালন্দা আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম। সেখানে গিয়ে নালন্দা রাজগীরে উৎখননে প্রাপ্ত নানা মূর্তি,সিল,পাত্র ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় ঘটল।

প্রায় সারাদিন কাটিয়েও ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। বুদ্ধ,মহাবীরের পদধূলি ধন্য নালন্দাকে তবু বিদায় জানাতেই হল। চড়ে বসলাম আমাদের গাড়িতে। আর মনে মনে বললাম-'নালন্দা,আবার আসব!'












শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০

কথাঃ পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছিল শেরফুলের মা (pisima k ata ene diyechilo sherfuler ma)


কথাঃ

 

 পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছিল শেরফুলের মা

 

 

রীক্ষার খাতায় পিছনের দিকের ছাত্রদের হাবিজাবি উত্তরের সঙ্গে আমরা শিক্ষকেরা কমবেশি সকলেই পরিচিতসেই হাবিজাবি উত্তরের মধ্যে এবার একটা ভিন্ন রকম কথা পাওয়া গেল সহকর্মী শিক্ষকবন্ধু  ক্লাস নাইনের ভৌত বিজ্ঞানের শেষ মূল্যায়নের খাতা দেখছিলেন কথাটা দেখালেন উনিই প্রশ্ন ছিল,ব্লেড জলে ভাসে কোন ধর্মের জন্য উত্তরে একটি ছেলে লিখেছে,হিন্দু ধর্মের জন্য

এটা সংশ্লিষ্ট ধর্মের গরিমা না নিন্দা,নাকি কোনওকিছুই না ভেবে লেখা,তা ছাত্রটিই জানে কিন্তু   পারিপার্শ্বিক ঘটনা যে কোমলমতি ছাত্রদের মনেও প্রভাব ফেলছে,এটা পরিষ্কার

আমি জন্মেছি এই দেশে কিন্তু আমার পূর্বপুরুষ দেশভাগের ক্ষত নিয়ে একদা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন এখানে শুনেছি, দেশ পরিবর্তনের কারণে ধনী থেকে রাতারাতি গরিব হয়ে গিয়েছিলাম আমরা আমাদের  মানুষ করে তুলতে  সীমাহীন শ্রম এবং অশেষ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল বাবা মাকে কিন্তু তার জন্য তাঁদের কখনও বলতে শুনিনি, এর জন্য দায়ী মুসলিমেরা  যে কষ্ট,দুর্গতি এদেশে এসে প্রথমদিকে তাঁরা পেয়েছিলেন,তা তাঁদের প্রাপ্য ছিল না,কিন্তু দেশ যে সাধারণ মানুষ ভাগ করে না, বোধবুদ্ধি তাঁদের ছিল তাই কখনও প্রতিবেশী ধর্মের মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে দেখিনি তাঁদের উল্টে চিন্তায় আচরণে তাঁদের মধ্যে দেখেছি মিলনের,মানিয়ে চলার মানসিকতা মানুষকে ভালবাসতে গেলে ধর্মপরিচয়কে পাত্তা দিতে হবে এমন হীন প্রবৃত্তি তাঁদের ছিল না

এদেশে এসে বাবা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার কাজ পেয়েছিলেন মনে আছে, সেসময় ক্লাস ফোর থেকে  ফাইভে যেতে  পাস করতে হত যে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা তার জন্য গরিব প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকটির বাড়ির মাটির দাওয়ায় খেজুর পাতার মাদুর বিছিয়ে চলত পরীক্ষার আগে ফ্রি কোচিং  সেখানে এসে বসত যেমন পুষ্কর,সাধনে্রা তেমনই থাকত আজাহার,ইমরান হাবিবের মত গরিবেরাও

 একটা দহের উপর কাঠের স্ল্যাব-পাতা ব্রিজ পেরিয়ে বাবা স্কুলে যেতেন কাঠের স্ক্যাবগুলো বেশ কিছুটা   ফাঁক দিয়ে দিয়ে পাতা ফলে একটু অসাবধান হলেই ফাঁক গলে নিচে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকত বাবা যখন পঁয়ষট্টির কোঠায় এসেও আর্থিক কারণে এক্সটেনশন নিয়ে রয়ে গেছেন শিক্ষকতায়, চোখে  ছানি, কানেও শোনেন কম,তখন কোনওদিন উল্টো দিক থেকে ব্রিজ পার হয়ে এসেও দাঁড়িয়ে যেতেন  শরিফদা বা সালামদা কিম্বা সিরাজ সেখের মত কেউ হাত ধরে বাবাকে আবার ব্রিজটা পার করে দিয়ে  আসতেন

সিরাজ সেখ ছিলেন বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হঠাৎ একদিন,বলা নেই,কওয়া নেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন তিনি সেদিন বাবারও স্কুল কামাই, এবং তিনি বেপাত্তা পরে শুনেছিলাম,ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক না করে জলস্পর্শ না-করা প্রবল ধার্মিক মানুষটি  বেলা তিনটে অব্দি ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলেন বন্ধুর কবরে ধূপকাঠি গুঁজবেন বলে

বাবা যেদিন মারা গেলেন আমাদের প্রাক্তন অঞ্চলপ্রধান আশরাফ মুন্সী,বার্ধক্যের বাধা নিয়ে তিন কিলোমিটার হেঁটে আমাদের বাড়িতে এসে এমন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে শোকের বাড়িতে আমরা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম তাঁকে সামলাতেই  

ধর্মপরিচয়কে দূরে রেখে পরস্পরের মধ্যে এই প্রীতির বন্ধন,কিন্তু মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না ছিন্নমূল হয়ে এদেশে আসা পরিবার আমাদের ছোট্ট গ্রামটায় একেবারে কম ছিল না কিন্তু কোথাও ধর্ম এসে পরস্পরের মধ্যে দেওয়াল তুলেছে,এরকম দেখিনি বরং উল্টোটাই দেখেছি পাতানো কাকির প্রতি ভালবাসায় দূর গ্রাম থেকে প্রতিবেশি পিসিমাকে আতা এনে দিয়েছেন শেরফুলের মা খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যাওয়া বাবলুদাকে দু মাইল রাস্তা কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে এসেছেন রহিম রাজমিস্ত্রি প্রফুল্ল স্যারের গাছের বড় কাঁঠালটা বরাবর দেওয়া হয়েছে বস্তর আলির বাড়িতে

দেশভাগের দগদগে ঘা নিয়ে এদেশে এসেও বিদ্বেষবিষ থেকে  পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন আমাদের বাবা মায়েরা এবং চারপাশের বহু মানুষ আমরা দেশভাগের দুঃখ না পেলেও ফল ভোগ করেছি বিস্তর। কিন্তু কই তার জন্য তো আমাদেরও কখনও মনে হয়নি হাসানুলের সঙ্গে হারাধনের বন্ধুত্ব হতে পারবে না। যে জাতি-জটিলতা কখনও মনেই আসেনি এতবছর পরে  নিশ্চয় অন্য কারও প্ররোচনায় নতুন করে তাকে ফিরিয়ে আনব না। আর এড়িয়েও যাব তাঁদেরকে যাঁদের মধ্যে রয়েছে এই জাতি-জটিলতা।  

এর সঙ্গে ধর্মাচারণকে গুলিয়ে ফেলার কোনও কারণ নেই। আমার জামার তলায়ও পৈতে রয়েছে। ছিঁড়ে যাবার মুহূর্তে এখনও ব্যস্ত হয়ে যাই আর একটা সংগ্রহে। নিয়ম করে গায়ত্রী মন্ত্রও জপি স্নানের পর। কিন্তু মনে মনে জানি রোগ হলে ডাক্তারের কাছেই যেতে হবে। জীবন ধারণের জন্য রোজগারের ধান্দায় পথেও বেরোতে হবে । মন্ত্রের মত কিছুই হয়ে যাবে না। ধর্মাচারণ বড়জোর মনে একটা শক্তি আনতে পারে,ঠিক রাখতে পারে মনের ভরকেন্দ্রটাকে, এর বেশি ধর্ম দেয় না। এর বেশি আশা করতেও নেই। এর বেশি আশা করতে গেলে রাম রহিমের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবে।এবং প্রাপ্তি গুণ হবে শূন্য দিয়ে। এই করোনা সংকটেও মানুষের এই চৈতন্য এল না,এটাই আশ্চর্যের!