অণুগল্প
অন্ধকার
খেজুরগাছের নিচে কীসের একটা আওয়াজ হল। খড়মড়। চারদিকে জমাট অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষ চলছে। স্বদেশ টর্চটা জ্বালাল। দেখতে পেল না কিছুই। তবু সাবধান হল। সিতুদের বাড়ির পুরো রাস্তা টর্চটা জ্বালিয়েই রাখল।
-মামিমা! সিতুদের ঊঠানে এসেই হাঁকল স্বদেশ।
-সোদেশ আইসস নাকি?আয় আয়।
-আজ কী অন্ধকার মামিমা! আর আপনাদের রাস্তাটাও খুব জঙ্গলে ভরে
গেছে।
-তোর মামা তো লুক খুঁজতাসে কাটনের লেইগ্যা। আজকাল লুক মেলাই দুষ্কর। পূজা আইতাসে। ঝুপঝাড় একটু না কাটলে পোলাপানেরা রাইতে ঠাকুর দেখতে বাইর হইব কুন সাহসে!
সিতু ইত্যবসরে চা বানিয়ে হাজির।–স্বদেশদা চা।
-আবার চা করলি কেন? -লবানকে দেখছি না! স্বদেশ তাকাল এদিক সেদিক।
-লবানরে একটু দুকানে পাঠাইসি। তেল আনতে। এই সিতু একটু যা তো হ্যারিকেনডা লইয়া। অন্ধকারে নিমগাছটার তলে ও খুব ভয় পায়। আগাইয়া দ্যাখ তো!
-সিতু বস। আমি যাচ্ছি। নিয়ে আসছি লবানকে। মামিমা, মামাও তো ফেরেনি। টর্চ থাকে মামার কাছে?
-টর্চ তো পকেটেই থাকে। কিন্তু যা বেহুঁশ লুক,জ্বালাইব নাকি রাস্তায়! অন্ধকারেই গটমট কইরা চইল্যা
আইব।
হঠাৎ দুম আওয়াজ। হ্যারিকেনের কাচ ফাটল।–কাইল আনসি নতুন কাচ। মন লইতাসে কাচডা লইয়া এক্ষুনি সুখেনের মুখে ছুইড়া মারি। কুন হান থেইক্যা এইসব কাচ হে আমদানি করতাসে কে জানে!
সিতু ঘরের বিছানার তলা থেকে একটা পোস্টকার্ড নিয়ে আসে। দু টুকরো করে। এক টুকরো কাচে আটকে দেয়।
মা! উঠোনে লবানের গলা।–এই নাও তেল। বাবাঃ,কী অন্ধকার! আসাই যায় না। টর্চটাও জ্বলছে না ঠিকমত। কী ভয় যে লাগছিল!
-সিতু এবার যখন সুখেনের দোকান থেকে হ্যারিকেনের কাচ আনবি ,এনেই কী করবি বল তো? এনে কিছুক্ষণ গরম জলে ডুবিয়ে রাখবি। আমরা ভাল ফল পেয়েছি।
-‘আচ্ছা স্বদেশদা,শহরের মত বিজলি আলো আমাদের এ গ্রামে কি কখনও আসবে?
-হয়ত আসবে। দশ,কুড়ি বা তিরিশ বছর পর। ততদিনে-
-ততদিনে আমরার কাল শেষ হইয়া যাইব।
-হয়ত তাই। কিন্তু মামিমা আমি ভাবছি অন্যকথা। গ্রামে বিজলি এলে শহরের মত আমাদের এমন রাতটাও তো হারিয়ে যাবে। এই অন্ধকার,নিমতলা,ভয়,মাটির দাওয়ায় বসে আধো অন্ধকারে এই আমাদের গল্প করা,তারপর রান্নাঘরে কূপি জ্বেলে আর কদিন বাদে আপনার পুজোর
নাড়ু করা, কী হবে সেসবের! বিজলির আলোর গল্প হয়ত আলাদা হবে, কারণ বিজিলির আলোয় অন্ধকারের এই সব গল্প জমবে না।
-সোদেশের কথা শুনলে হাসি পায়। কী একটা গল্প আসিল না,সিতুরা পড়সে,ওই যে ক’ না,শিয়ালে আঙ্গুর ফল খাইতে গিয়া,লাফাইয়া পাড়তে পারে নাই,তখন কী যেন
কইয়া চইল্যা গেল-
-আঙুর ফল টক। লবান ঘর থেকে জবাব দেয়।
স্বদেশ হাসে।-সে আপনি যাই বলেন মামিমা,
বিজলি এলে তারাভরা আকাশ,পূর্ণিমার চাঁদ সব ঢাকা পড়ে যাবে।
-ওইসব দিয়া কী হইব সোদেশ ? আজ দেখসস কী
গরম পড়সে,গাছের একটা পাতাও নড়তাসে না। বিজলি আইলে তো পাখার বাতাস খাইয়া বাঁচতাম।
লবান পুরোপুরি মার দিকে। কিন্তু সিতু বুঝতে পারে
না,সে কোন দিকে যাবে। আলোর দিকে না অন্ধকা্রের দিকে? বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক হয়েছে। শহরে ফ্ল্যাট। সুচাকুরে। সব দিক থেকেই আলো। কিন্তু সিতুর কি সামনের অন্ধকারটা ফেলে সে-আলো
সহ্য হবে? ভালও কি লাগবে?
চল্লিশ বছর পরে আর এক গল্প
আলো
বিপদ একা আসে না। ঝড়ে আজ কাচ ভাঙল জানলার।
আর তারপরেই বাজ পড়ে নষ্ট হয়ে গেল নতুন টিভিখানা। ঝড়বৃষ্টি কমলে শুরু হলে খোকনের পেটে
যন্ত্রণা। ওষুধ নিয়ে সিতু ওঘর থেক আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল। ওপড়াল বাঁ পায়ের বুড়ো
আঙুলের নখ।
কীভাবে কোনটা সামলাবে ভেবে পেল না দুজনে।
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। এ অবস্থায় কে খুলবে দরজা! পেটে হাত দিয়ে স্বদেশই গেল। বিদ্যুৎ
অফিসের লোক। বিল নিয়ে এসেছে। তিনমাসের বিল।
বিলের অঙ্ক দেখে স্বদেশের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বিলটাকে
ফ্রিজের উপর চালান করে,ওষুধের বাক্সটা বের করল। ওষুধ খেল। সিতুর পায়ের বুড়ো আঙুলে লাল
ওষুধ দিয়ে ন্যাকড়া জড়িয়ে দিল।
-বিল কত এলো গো?
-সাত হাজার তিনশো পঁয়ত্রিশ।
-কীভাবে দেবে? অপুকে কি বলব?
-না থাক। যে ছেলে সেভাবে খোঁজই নেয়
না বাবা মায়ের,তাকে আর-
-তা ঠিক। কিন্তু-তোমার চাকরি থাকলে
তো আর- করোনা সব খেয়ে গেল! সিতুর গলা বুজে এল কান্নায়।
বিদ্যুৎ বিল না দিতে পারায় একদিন লাইন
কাটা পড়ল স্বদেশদের।
অন্ধকারে ব্যালকনিতে সেদিন বসে রয়েছে
দুজনে । হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা ধরতে গিয়ে কেঁপে উঠল স্বদেশ। -কে ফোন করেছে গো?
জবাব দিল না স্বদেশ।
সিতু শুনল স্বদেশ ফোনে বলছে-ভালো আছি
আমরা। তোরা কেমন আছিস?-না,না চিন্তা করার দরকার নেই।-ও জিম,জিম চাঁদ দেখছে ছাদে উঠে?
জিমকে বলিস ওর দাদু ঠাকুমাও ব্যালকনিতে বসে চাঁদ দেখছে। পূর্ণিমা,খুব বড় চাঁদ উঠেছে
আজ। খুব বড়…
-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন