কথাশিল্পী আশাপূর্ণা
রোমাঞ্চিত প্রকাশক বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য শুধোলেন,'উপন্যাসের নামটা কী হবে?' লেখিকা বললেন,'লিখব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি,সুতরাং নামটা 'প্রতিশ্রুতি'ই থাক!' তারপর একটু ভেবে বললেন,' না...না,নামটা 'প্রথম প্রতিশ্রুতি'ই কোরো। কারণ, এটাও তো প্রথম প্রতিশ্রুতিই!'
আশাপূর্ণা দেবীর 'প্রথম প্রতিশ্রুতি'র এই সূচনা-কাহিনি সবিতেন্দ্র রায় লিখেছেন তাঁর 'কলেজস্ট্রিটে সত্তর বছর' বইতে। লিখেছেন, সাময়িক পত্রে ধারাবাহিকভাবে 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' প্রকাশিত হওয়ার সময়ে কেমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা হয়েছিল,তার কথাও।
এই বই নিয়ে নবনীতা দেবসেন দরবার করেছেন জ্ঞানপীঠ কমিটিতে। বাংলা ভাষার জ্ঞানপীঠ কমিটিতে তখন নবনীতা দেবসেন ছাড়া অন্য দুজন ছিলেন প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত ও অমলেন্দু বসু। আশাপূর্ণা তখনও সাহিত্যের বৌদ্ধিক মহলে 'ঘরকন্নার লিখিয়ে' হিসেবেই পরিচিত।
নবনীতা দেবসেনের মুখে আশাপূর্ণার 'প্রথম প্রতিশ্রুতি''র কথা শুনে অন্য দুজন এককথায় নাকোচ করে দিলেন। বইটি তাঁরা পড়েছেন,তাও নয়। তবু,মহৎ সাহিত্যের কোঠায় যে 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' পড়বে না, এ ব্যাপারে তাঁরা প্রায় নিশ্চিত। হাল ছাড়লেন না নবনীতা দেবসেনও। ঠিক হল,আবার পরের সপ্তাহে বসবে মিটিং,তখনই ফয়সালা হবে এই নিয়ে। এবং এর মধ্যে,অনিচ্ছুক সদস্যদ্বয় পড়ে নেবেন উপন্যাসখানা।
পরের মিটিংয়ে পুরোপুরি পালটে গেল অন্য সদস্যদের মত। দু'জনেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ উপন্যাসটি নিয়ে। অমলেন্দুবাবু দিল্লি গেলেন,বাংলা ভাষার পক্ষ থেকে 'প্রথম প্রতিশ্রুতি'র হয়ে লড়তে। যুক্তি সাজিয়ে দিলেন নবনীতা দেবসেনই।
এর পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। ১৯৭৫,আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের বছরে দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ পেলেন আশাপূর্ণা দেবী,তাঁর অসামান্য গ্রন্থ 'প্রথম প্রতিশ্রুতি'র জন্য।
জ্ঞানপীঠ ছাড়াও সারাজীবনে আশাপূর্ণা পেয়েছেন অজস্র সম্মান। পদ্মশ্রী, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম,বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট।
প্রতিষ্ঠার এই জায়গায় পৌঁছনো কিন্তু সহজ ছিল না আশাপূর্ণার। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। স্কুলে যাওয়া দূরস্থান,অক্ষর পরিচয়ই হয়েছে বড় অবহেলায়। পড়বে কেবল ছেলেরা,এই ছিল বাড়ির আইন। ঠাকুমা বিশ্বাস করতেন,স্কুলে গেলে মেয়েরা বাচাল হয়। অতএব,দাদা-ভাইদের পড়াশোনার আড়ালে,তাদের বই পড়েই নিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ। ছোটবেলা থেকেই আশাপূর্ণা ছিলেন যাকে বলে স্ব-শিক্ষিত,তাই।
হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত আর সরলাসুন্দরীর ন'টি সন্তানের তিনি ছিলেন পঞ্চম।আর কন্যা হিসাবে তৃতীয়। আশাপূর্ণা নামটি ঠাকুমারই দেওয়া। এই নাম একেবারে অকারণে নয়। তৃতীয় কন্যা সন্তানে মেয়ের স্বাদ মিটেছে,পূর্ণ হয়েছে আশা। তাই তাঁর নাম আশাপূর্ণা।
১৯০৯ সালের ৮ জানুয়ারি পটলডাঙায়,মামার বাড়িতে জন্ম তাঁর। আর তিরোধান ১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই। দীর্ঘ জীবন । শৈশবের সূচনার দিনগুলো কেটেছে বৃন্দাবন বসু লেনের একান্নবর্তী পরিবারের হাজারো নিষেধাজ্ঞায়। তবে সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে আশাপূর্ণার জীবনে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল বাড়ি-বদলের ঘটনা।
মা সরলাসুন্দরী পরিবারের শাসন-বারণে হাঁফিয়ে উঠে আলাদা হয়ে চলে আসেন আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে। মা ছিলেন বইপাগল। প্রচুর পত্র-পত্রিকা নিতেন নিয়মিত। এই পরিবেশে আশাপূর্ণারও সঙ্গী হয়ে ওঠে বই,ম্যাগাজিন। মনে মনে লেখার বাসনাও পল্লবিত হতে থাকে।
তেরো বছর বয়সে 'শিশুসাথী' পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন একটি কবিতা,'বাইরের ডাক'। ছাপা তো হলই,সম্পাদকের তরফ থেকে এল গল্প লেখার অনুরোধও। সাহিত্যের অঙ্গনে বলা যায় পাকাপাকিভাবে প্রবেশ ঘটল আশাপূর্ণার। তারপর,সারাজীবন ধরে অজস্র গল্প-উপন্যাসে মাতিয়ে রাখলেন বাংলা সাহিত্যের পাঠককুলকে। নিজেকে তিনি বলতেন,'মা সরস্বতীর স্টেনোগ্রাফার'।আর লেখার ব্যাপারে তাঁর আদর্শ ছিল,লিখবেন তা-ই যা হয়। যা হওয়া উচিত তা নিয়ে লেখার পক্ষপাতী ছিলেন না। নিজেকে সে কাজের যোগ্যও ভাবতেন না।
বইয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থেকে চেয়েছিলেন তাঁর স্বামী হবেন একজন লাইব্রেরিয়ান। প্রাণ-খুলে বই-পত্র পড়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু পনেরো বছর বয়সে যাঁর সঙ্গে বিবাহ স্থির হল,দেখা গেল তিনি একজন ব্যাংক কর্মচারি। বাড়ি কৃষ্ণনগর। তবে,আশাপূর্ণার স্বামীভাগ্য ভাল। সাহিত্যের পথে স্বামী কালিদাস গুপ্তের উৎসাহ,সাহায্য পেয়েছেন সদা-সর্বদা।
বিবাহের সময় সাময়িক অসুবিধায় পড়েছিলেন। একে তো কলকাতা ছেড়ে কৃষ্ণনগর আসা,তার উপর শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখেন সাহিত্যচর্চার পাট একেবারেই নেই। বই বলতে রয়েছে দু-একটি ধর্মগ্রন্থ আর পঞ্জিকা। বউমা বই পড়তে ভালোবাসেন জেনে,শ্বশুরমশাই কলকাতা থেকে বই আনিয়ে দিতেন। কিন্তু তাতে মনের খিদে আর কতটুকু মেটে!
কৃষ্ণনগরে ছিলেন দু'বছর। এরপর শ্বশুরবাড়ির পরিবার কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে আসে। প্রথমে রমেশ মিত্র রোডে,পরে বেলতলা রোডে। বেলতলা রোডের বাড়িতে দীর্ঘসময় কেটেছে তাঁর। বড় রাস্তার উপরে কোনও বাড়িতে থাকতে খুব পছন্দ করতেন। যে কারণে পরবর্তীকালে গোলপার্কের সরকারি ফ্ল্যাট ছেড়ে নতুন বাড়ি করে এসে ওঠেন গড়িয়ায়।
গড়িয়ার বাড়িতে জানলা দিয়ে দেখতেন গাড়িঘোড়া ,মানুষজন। জানলা দিয়েই নানান চরিত্র,ঘটনা এসে ভিড় করত তাঁর লেখায়। নবনীতা দেবসেন লিখেছেন-'তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ,বিশ্লেষণ,কল্পনাশক্তি,দূরদৃষ্টি,বুদ্ধি ও শ্রমশক্তি ছিল তাঁর জোরের জায়গা।'
এই জোর দিয়েই চার দেওয়ালের বাইরে না-গিয়েও তিনি সৃষ্টি করেছেন অসামান্য এক একটি আখ্যান। তিনি বলতেন, ছোটগল্প লেখা তাঁর প্রেম,আর উপন্যাস রচনা তাঁর কাজ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের পাঠক জানেন,এই দুই মিলিয়েই তিনি বাংলাসাহিত্যে গড়ে গিয়েছেন স্থায়ী এক ইমারত।
দারুণ হয়েছে পড়ে খুব ভালো লাগল
উত্তরমুছুনদুরন্ত।
উত্তরমুছুন