মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০২০

কথাঃ আবোলতাবোল (আমার বাংলাদেশ)

কথাঃ আবোলতাবোল



আমার বাংলাদেশ



মৈমনসিংহ,কিশোরগঞ্জ,নেত্রকোনা,পূর্বধলা ,কালদুয়ার - নামগুলো ছোটবেলাতে আমাদের চারপাশে ঘুরত,পাক খেত। কখনও বাবা সান্ধ্য মজলিসে বসে হারিয়ে যেতেন ফেলে আসা ওইসব জায়গায় , আবার কখনও ঘুম না আসা ছুটির দুপুরে মার গলায় জলতরঙ্গ হয়ে বাজত  ওইসব জায়গার স্মৃতি।

বাবা এদেশের আঞ্চলিক বা মান্য কোনও উপভাষাই  শেখার কথা ভাবেননি। মা শিখেছিলেন, তবু এদেশে আসার পর জীবনের পরবর্তী ষাটটি বছর পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক উপভাষাতেই  কথা বলে গিয়েছেন। 

আমাদের বাড়ি জুড়ে থাকত বাংলাদেশের সোঁদা গন্ধ,মিঠে সুর,সেখানকার আচার,ব্রত,ঘরকন্নার টুকিটাকি এবং অবশ্যই কিছুটা ঘটি-বিদ্বেষ। 

এত বাংলাদেশ নিয়ে বড় হলেও পিতৃপুরুষের বাংলাদেশের একটা ছবি আঁকা আমার পক্ষে কঠিন ছিল। কারণ মুখের স্মৃতিকথায় ভূগোল থাকে অস্পষ্ট। আর  সময় এত আগুপিছু করে যে ঠিক মেলানো যায় না ঘটনাক্রম। অন্যদিকে সমসময়ের  বাংলাদেশ বলতেও আমার তখন যৎসামান্য পুঁজি।  শেখ মুজিবুর রহমান,শামসুর রহমান,রুনা লায়লা,সাবিনা ইয়াসমিন,আর দুপুরের দিকে রেডিয়োয় কলকাতা সেন্টার কাজ না করলে কাঁটাটা একটু এপাশে ওপাশে সরিয়ে ,মণিহার সিনেমা। 

পুঁজি বাড়ানোর ইচ্ছেও কি ছিল? বোধহয় না।

কলেজে পড়ার সময়,ছুটির সকালে দিদি সাতটা চল্লিশের আকাশবাণীর রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর বাংলাদেশ ধরাত। সেখানে কাদেরি কিব্রিয়া,সঞ্জিদা খাতুনের রবীন্দ্রসংগীত শুনে মুগ্ধ হতাম। ব্যস ওই পর্যন্তই।

আমার বাংলাদেশ সত্যিকারের বড় হল মাসিমার দৌলতে।  কিশোরীবেলার স্মৃতিকথা 'লাজুকলতা' মাসিমা ধারাবাহিকভাবে লিখলেন 'দেশ' পত্রিকায়।  কিন্তু এ-ও তো অতীতের ঘটনা, স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের গল্প। বর্তমান কই?  

'দেশ'পড়ার সুবাদেই  বর্তমান  এল। তবে  ধীরে ধীরে। শামসুর রহমান,আল মাহমু্‌দ  তো ছিলেনই। এলেন তসলিমা নাসরিন বেলাল চৌধুরী, জয়নুল আবেদিনেরা । তাঁদের  নতুন বিদ্রোহ, আলাদা স্বর,ভিন্ন চিত্রভাষা নিয়ে। হুমায়ুন আহমেদের নাম অনেক আগেই শুনেছিলাম,কিন্তু বই পড়িনি কোনও। একবার'দেশ' পত্রিকার শারদ সংখ্যায় তাঁর উপন্যাস পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম একটা দুপুর।  তবু স্বীকার করতে বাধা নেই এতকিছুর পরেও কাঁটাতারের ওপারের প্রতি একটা উদাসীনতা থেকেই গিয়েছিল।

এমনকী  সাদাকালোর টিভির যুগে যখন ঘরে  ঘরে  বিটিভি ঢুকল, এখানকার  মাত্র দুটো চ্যানেলের বাইরে অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে অতিরিক্ত  এই একটা চ্যানেলের নাটক আমাদের স্তম্ভিত করে দিতে লাগল,তখনও। 

বাংলাদেশ তাঁর কৃষ্টি নিয়ে আমার  মনে পাকাপাকি বসত গড়ল,ঘরে  কম্পিউটার আসার পরে। ইউটিউবে চঞ্চল চৌধুরীর নাটক দেখা নেশা হয়ে উঠল। মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে সেভাবে জানতামই না। কম্পিউটার তাঁকে নিয়ে এল একেবারে সামনে। ছোটদের লেখা পড়তে বরাবরই ভালবাসি। সেই ভালবাসার টানে তাঁর 'দীপু নাম্বার টু','আমার বন্ধু রাশেদ''আমি তপু' ,'মেকু কাহিনী' 'হাতকাটা রবিন' এইসব বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড করে রাত জেগে জেগে পড়ে চললাম দিনের পর দিন। 

স্কুলের কম্পিউটারে ইউটিউব খুলে 'আমার বন্ধু রাশেদ','দীপু নাম্বার টু' ছবি দুখানা শিক্ষকেরা অনেকে মিলে দেখলাম ।  অনেকে আমার পেনড্রাইভ থেকে ছবি দুখানা কপি করে বাড়িতে দেখাবেন বলে  নিয়েও গেলেন। আমরা বইমেলায় স্কুল লাইব্রেরির জন্য কিনে আনলাম সুনীল গাঙ্গুলীর কাকাবাবু সিরিজের সঙ্গে হুমায়ুন আহমেদের হিমু সমগ্র,মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন।

ততদিনে ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কারণে বাংলাদেশের আরো অনেক সাহিত্যসম্ভারের দিকে দৃষ্টি গিয়েছে। সেবার বইমেলাতেই   ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য কিনলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক,সেলিনা হোসেনের বই। 

এরপর ইউটিউবেব  রণদামামা বাজিয়ে এলেন কিশোর গায়ক মাহতিম সাকিব। তাঁর গান ,গায়নভঙ্গীতে শুধু আমি নই মজে গেলেন আমাদের আরও অনেক শিক্ষক, শিক্ষিকাও। বর্ষার দুপুরে,মাহতিমের 'মনমোর মেঘের সঙ্গী' চালিয়ে শুয়ে থাকা আজ আমার কাছে সেরা এক  বিলাস। 
এর পরে মন প্রাণ জুড়ে এল  আর এক কিশোর। রাজশাহীর শিশির বাউল। দোতারা বাজিয়ে তাঁর মুর্শিদ ধন হে'  শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। শুধু আমিই নই। রান্নাঘর থেকেও হাত খুন্তির আওয়াজের ফাঁক দিয়ে আজকাল ভেসে আসে গুনগুন,'মায়াজালে বন্দি হইয়া আর কত কাল... । 

আর নাটক? চঞ্চল চৌধুরী,জিয়াউল ফারুক অপূর্ব,তানজিন তিশা,নূসরত ইমরোজ তিশা,বৃন্দাবন দাস,আফরান নিশো এইসব শিল্পীরা  এখন আর শুধু বাংলাদেশের নয়। আমাদেরও। 

বেশ লাগে পড়ার বাইরে স্বাদ বদলের ইচ্ছায়  ছাত্রদের কেউ যখন ক্লাশে বলে ওঠে-'স্যার, লাড্ডু কীভাবে রাশেদ হল,সেই অব্দি পড়েছিলেন আগের দিন। আজ কি পড়বেন  পরের থেকে?'

ওদের আনন্দ দিতে আমি মোবাইলের ফাইলে থাকা 'আমার বন্ধু রাশেদ'এর পাতা উলটে যাই একটা একটা করে ।

 রাশেদের স্রষ্টা কি জানেন, এদেশের এক অখ্যাত স্কুলের দুপুরবেলাগুলোতে  আমরা আজও তাঁর বইয়ে ডুব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আঁচ নিই! আর ছত্রেরা ছুটির সময় বেরিয়ে সমস্বরে চীৎকার করতে  করতে যায়,'ইয়াহিয়ার চামড়া/তুলে নেব আমরা'!'










 















৬টি মন্তব্য:

  1. মুগ্ধ. হুমায়ুন আহমেদের মিসির আলী সিরিজ ও দারুণ.

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারণ। কি লিখে চলেছিস বস্! আমি রিতিমত নিজেকে সমৃদ্ধ করছি তোর লেখনী থেকে।
    সৌরভ

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ। কি লিখে চলেছিস বস্! আমি রিতিমত নিজেকে সমৃদ্ধ করছি তোর লেখনী থেকে।
    সৌরভ

    উত্তরমুছুন
  4. মন্তব্য করা নিরর্থক। সত্যিই সুদীপ তোর লেখা পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। আমার তো তোদের মতো ভাষা জানা নেই। তাই আমি গুছিয়ে comment করতেও পারি না। তা ছাড়া তোর মত এত পড়াশুনাও নেই। আবার বলি ভীষণ ভালো লিখেছিস। অরূপ

    উত্তরমুছুন