রবিবার, ২ আগস্ট, ২০২০

কথাঃ সেই বাঁশি ফিরে আর আসবে কি?


কথাঃ

 

সেই বাঁশি ফিরে আর আসবে কি?   

 

 

একটা জলের বোতল তোবড়ানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে ড্রেনটায় একটা টিফিনকৌটোর ঢাকনা  ওয়ার্কশপের সামনের পেয়ারাগাছটার নিচে শুয়ে আছে কাত হয়ে একটা ঝুলকালি লাগা পোশাক ঝুলছে গোডাউনের কাছের বিবর্ণ দড়িটায় কিন্তু টাইম অফিসের সামনের ধাপিটার নিচে প্রায়-জীবাশ্ম অবস্থায় পড়ে কী ওগুলো? তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি অনেককষ্টে উদ্ধার হয়, একদা ওগুলো ছিল কারও  খাদ্যাবশেষ  এতবছরের প্রাকৃতিক ক্রিয়াবিক্রিয়া সামলে কীকরে ওরা আজও টিকে থাকল,সেই বিষ্ময়ে ওখানে কিছুক্ষণ  দাঁড়িয়ে যাই চুপচাপ কলরব মুখরিত সেইসব অতীত দিন হঠাৎই ছুটে আসে হু হু করে

কত মানুষ,কত মেশিন,কত কর্মব্যস্ততা! ওই তো নন্দীবাবু শেডে ঢুকছেন  চার নম্বর রিংফ্রেমে আগুন লাগার খবর পেয়ে ক্যান্টিনে কীসের সোরগোল? নিশ্চয় ওয়ার্কারদের  ঠিকমত খাবার দেয়নি  ভেন্ডার এদিকে কুন্ডুবাবু টাইমফিসে দাঁড়িয়ে আছেন চিন্তিত মুখে ব্লোরুম চালাবার লোক আসেনি   ভাবছেনবদলিথেকে কাউকে নেওয়া যায় কি না এসময় দোতালা থেকে নেমে সামনে হীরা পূজারকে চলে যেতে দেখে প্রধানবাবু চেঁচান-‘ হীরা,হীরা,এই নোটিশবইটা ম্যানেজারের টেবিলে দিয়ে এসো তো!’

অনেক ফুলগাছ লাগিয়েছি মিলের নানা জায়গায় এসো দেখাই তোমাকেসম্বিত ফেরে,বন্ধ মিলের  এখনও রয়ে যাওয়া এক অফিসারের কথায় ওঁর সঙ্গে যন্ত্রের মত এগিয়ে চলি,মিলের নানা কোনে জিনিয়া ডালিয়ার সৌন্দর্য অবলোকন করতে  

জঙ্গলে ভরা বিশাল মিলটাকে অতীতের প্রেতচ্ছবি লাগে শেডের সামনের রাস্তাটায় দেখি ঘুঘু চরছে  একজোড়া ভিটেতে ঘুঘু চরার পিছনে আস্ফালনের একটা গল্প থাকে অনেকসময় এই ঘুঘু চরে বেড়ানোর পিছনে আর  যাই হোক কোনও আস্ফালন ছিল না অথচ আজ বাস্তব এটাই যে সব কলরব থেমে গেছে মিলের ভোঁ  বাজে না আর বিটি রোডের ধারের গল্প লেখার জন্য সমরেশ বসু ছিলেন কিন্তু রায়গঞ্জ থেকে বালুরঘাটগামী রাজ্য সড়কের ধারে এই  সুতো মিলের গল্প লিখবে কে?  

শিল্পে অনগ্রসর উত্তরবঙ্গ যথেষ্ট আশা নিয়েই তাকিয়েছিল সেদিন সদ্য চালু হওয়া ঝাঁ-চকচকে এই   মিলখানার দিকে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর কমার্শিয়াল প্রোডাকশন চালু হতে এলাকার কর্মী মানুষজনেদের  দিনযাপনেও মিশে গিয়েছিল মিলের আওয়াজ মিলের নানা বিভাগ আর  সেখানকার মেশিনারি ঘিরে নানা অচেনা শব্দ ধীরে ধীরে পাকাপাকি প্রবেশ করেছিল তাঁদের শব্দভান্ডারেববিন’ ‘পিসিং’ ,স্ল্যাইভার’ ‘ডফ’, ‘হ্যাঙ্কএসব শব্দ শেষঅব্দি হয়ে উঠেছিল তাঁদের জীবনেরও শব্দ

২০০০ সালের গোড়া থেকেই নানা কারণে মিলের অবস্থা টালমাটালতবু চলছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সবাই ভাবছিল সেই গানের কথার মতই,we shall overcome some days.কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো আর হয়নি  সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক ছিল মেশিনপত্রের অনাধুনিকতা অন্য কারণ আজ আর কাটাছেঁড়া না করাই ভাল ২০১১ সালের ১১ জুলাই পাকাপাকি বন্ধ হয়ে গেল প্রোডাকশনমিল না চললে,কী হবে আমাদেরএই হাহুতাশ কর্মীদের মধ্যে ২০০৬ থেকেই শুরু হয়েছিল প্রোডাকশন পাকাপাকি বন্ধ হতে,বেতন চালু থাকলেও,বাতাস ক্রমেই ভারী উঠেছিল দুশ্চিন্তায়  

বসে বসে বেতন কেউ বেশদিন দেয় না বন্ধ মিলের কর্মীদের দুর্গতির গল্পটা সকলেরই জানা কলকাতার  আশেপাশে বন্ধ হয়ে যাওয়া  বেসরকারি,আধা  সরকারি মিলের কর্মীদের ঋণভারে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেবার নানা গল্প উড়ে এসে তখন জুড়ে বসছে কর্মীমানুষগুলোর চিন্তার দাঁড়ে তেমন ভবিতব্যই কি তবে অপেক্ষা করে আছে তাঁদের জন্যও!

২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু হল সমস্ত স্তরের কর্মচারীদের সরকারি নানা বিভাগে বদলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন কর্মীরা অনিশ্চিতের জীবন এসে নোঙ্গর ফেলল নিশ্চিন্ততার ঘাটে কিন্তু মনের সুখ কি অতই সোজা!

মিল থেকে রায়গঞ্জ বিডিও অফিসে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন রিংফ্রেমের অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিটার অমিত রায় তিনি আজও মিলের সেই দিনগুলোকে দারুণভাবেমিসকরেন একমাস আগে পেনসন সংক্রান্ত কাজে গিয়েছিলেন মিলে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি যে মিলে কেটেছে তাঁর যৌবনের রঙীন দিনগুলো কখনও আনন্দে কখনও বেদনায়,যেখানে বন্ধুত্বের উষ্ণতায় খুঁজে পেয়েছেন বাকি জীবনের রসদ,   কী অবস্থা হয়েছে তার! সেদিনের কথা স্মরণ করে ফোনের অপর প্রান্তে শ্রীরায়ের কণ্ঠস্বরে আজও বিষণ্নতার ছোঁয়া  

রায়গঞ্জের বছর একত্রিশের যুবক অরিজিৎ যখন নবম দশমের ছাত্র,বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই যেতেন মিলের  দিকে ঘুরতে দেখতেন মিলের গেটে শিফট চেঞ্জএর সময় কর্মীদের জমায়েত মিলের ভোঁ পড়লে,  রাস্তায় ভিড়ের জন্য দাঁড়িয়েও যেতেন অনেকসময় তিনি আজও,তাঁর শিক্ষকতার পেশায় অবসর পেলে, বিকেলের দিকে যান ওদিকে মিলের তিনি সে অর্থে কেউ নন,কিন্তু আলোকিত চত্বরের জমাট আঁধারটা বুকে এসে ঝাপটা দেয় তাঁর নীরব হয়ে যাওয়া ওইটুকু রাস্তা পার হতে বেশ কষ্ট হয় অরিজিতের

আর চলে গিয়েও ফিরে ফিরে একসময়ের কর্মস্থানটা দেখতে আসা সেদিনের সুপারভাইজার? ‘আমি যন্ত্রের  মতো মেশিন থেকে সে মেশিন ঘুরে বেড়াইআনমনে রিংফ্রেমের স্পিন্ডিল থেকে ববিন  তুলে ছেঁড়া সুতো জোড়া দিই আনমনে স্পিডফ্রেমের তৈরি রোভিং রিংফ্রেমে লাগাই আনমনে ড্রফ্রেমের স্ল্যাইভার জুড়ি আনমনে কার্ডিং মেশিনে কটন ফাইবারের ওয়েব নিরীক্ষণ করি আনমনে ঘুরে বেড়াই  ব্লোরুম আবার শুরু থেকে যখন একেবারে শেষ ডিপার্টমেন্ট রিলিংএ পৌঁছাই তখনও আমার অন্যমনস্কতা  কাটে নামনে হয় সুতো  তৈরির কারখানায় যেন আমি আনপড়…’, জীবনের ট্রাজেডি এটাই সেদিনের সেই আনপড় সুপারভাইজারের ক্লান্তিতে ভিজে যাওয়া ডায়েরির পাতা আজও কিন্তু রাত্রি গভীর হলে বাজিয়ে দেয় মিলেরই বাঁশি

বাস্তবে সে বাঁশি কি বেজে উঠতে পারে না আবার? বিশাল জমি আটকে পড়ে আছে মিলখানা সুতো গেছে হতেই পারে অন্যকিছু শিল্পদীন উত্তরবঙ্গে নতুন একটা শিল্পের স্বপ্ন কিন্তু এই মিল ঘিরে আজও রয়েছে সেখানকার মানুষজনের মধ্যে


৫টি মন্তব্য:

  1. ইউনিয়ন বাজিই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল মিলটাকে। 1987-88 তেই বুঝতে পেরেছিলাম কেউ এই মিলটাকে বাঁচাতে পারবেনা।
    যাক, তোর বর্ণনা অপূর্ব। অসাধারণ। আমারও খারাপ লাগে কারণ কর্মজীবন টা ওখান থেকেই শুরু করেছিলাম যে!

    উত্তরমুছুন
  2. ইউনিয়ন বাজিই মিলটাকে বারোটা বাজানোর মূলে। আমি 1986-87 তেই বুঝতে পেরেছিলাম যে এর আয়ু বেশী দিন নেই। খারাপ লাগে ভাবলে, কারণ তোর, আমার কর্মজীবনের পথচলা যে ওখান থেকেই শুরু হয়!
    যাক, তোর উপস্থাপনা অপূর্ব, অসাধারণ।
    সৌরভ।

    উত্তরমুছুন
  3. Amra oneke e mill e kaaj kori ba korechhi. Kintu mill er proti ta chhoto boro ghotonar eto sundor detailing ar ebhabe jibonto kore tola, ek kothay osadharon.

    উত্তরমুছুন
  4. এত সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করার জন্য সৌরভ,দেবাশিস,নুরুল সবাইকে ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন