মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০২০
কথাঃআবোলতাবোল (বাংলা প্রবাদের পুনর্লিখন প্রস্তাব)
সোমবার, ২৯ জুন, ২০২০
গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক (সিনেমা ও বিভূতিভূষণ)

গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক
সিনেমা ও বিভূতিভূষণ
যে চলচ্চিত্র শিল্পমাধ্যমটি বিভূতিভূষণের
বেশ কিছু অমর সৃষ্টির সঙ্গে সারা বিশ্বের পরিচিতি ঘটায়, সেই শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে
বিভূতিভূষণের যোগ কতটুকু?
শুনলে অবাক লাগবে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে
বিভূতিভূষণের যোগ এদেশে চলচ্চিত্রের শুরুর সময়টাতেও ছিল অত্যন্ত নিবিড়। দেশি বিদেশি দুই ধরণের চলচ্চিত্রেরই
রীতিমত ভক্ত ছিলেন তিনি।
বিভূতিভূষণের দিনলিপির পাতা ওল্টালে
দেখা যাবে কলকাতার মেসজীবনে তাঁর যাতায়াত শুধু ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি, বন্ধুবান্ধবদের
আড্ডা,আর ‘বঙ্গশ্রী’র অফিসে সীমাবদ্ধ ছিল না। রীতিমত যাতায়াত ছিল থিয়েটার সিনেমাতেও।
থিয়েটার সিনেমার মধ্যে পছন্দ বেশি করতেন
সিনেমাই। তাঁর দিনলিপিতে উঁকি দিলে দেখা যাবে,কখনও নীরদবাবুর (নীরদ সি চৌধুরী) সঙ্গে
তিনি রূপবাণীতে ইংরেজি সিনেমা দেখছেন,কখনও রাত্রিতে বঙ্গশ্রীর অফিস থেকে ফেরার পথে film দেখতে ঢুকছেন Madan
Theatreএ। আবার কখনও স্কুল ফেরতা ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে যাচ্ছেন ‘Abraham Lincon’ দেখতে।
শুধু কি দেখা? গতশতকের তিনের দশকে একটি
চলচ্চিত্র সাপ্তাহিকের তিনি সম্পাদকও হয়েছিলেন। ‘চিত্রা’ চলচ্চিত্রগৃহ
প্রতিষ্ঠা হলে তার মালিক বীরেন্দ্রনাথ সরকার এবং সে সময়ের প্রবাসী সম্পাদক কেদারনাথ
চট্টোপাধ্যায়ের যৌথ উদ্যোগে বের হয়েছিল এই চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক। পত্রিকার নাম ছিল,
‘চিত্রলেখা’। ‘চিত্রলেখা’র প্রথম সংখ্যা বের হয়েছিল ১৯৩০ সালের ১৫ নভেম্বর।
এই পত্রিকার প্রচ্ছদকাহিনি করা হত আন্তর্জাতিক
খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র পরিচালক,চিত্রাভিনেতা বা চিত্রাভিনেত্রীদের নিয়ে। দেশের ও বিদেশের ছবির বিস্তারিত
খবর থাকত ‘চিত্রলেখা’য়।
এই চলচ্চিত্র সাপ্তাহিকের সম্পাদক হিসাবে
বিভূতিভুষণকে নির্বাচিত করা হয়েছিল আকষ্মিকভাবেই। কাগজ তৈরির প্রারম্ভিক পর্যায়ে কথা
হয়েছিল,প্রবাসী প্রেস সংক্রান্ত কারও সম্পাদক হওয়া চলবে না। এই সময় কাকে সম্পাদক করা
যায় এ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। বিভূতিভূষণ তখন প্রবাসীর লেখক। চলচ্চিত্রে অনুরাগী
বিভূতিভূষণকেই দশ টাকা বেতনে নির্বাচিত করা হল সম্পাদক হিসাবে।
বিভূতিভূষণ এই পত্রিকার রথাগ্রে থাকলেও,সব
কাজ করতেন অবশ্য সজনীকান্ত দাস। তবে একেবারে নিষ্ক্রিয় সম্পাদক ছিলেন না বিভূতিভূষণ।
চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকার সম্পাদক তিনি হয়েছিলেন, অনেকটা এই শিল্পের সম্পর্কে হৃদয়ের
এক চোরাটান থেকেই। আর সেই টানেই তিনি এখানে লিখেছেন চলচ্চিত্র বিষয়ে প্রবন্ধও। এতে
পরিচয় পাওয়া যায় তিনি চলচ্চিত্রের কতটা সচেতন সমঝদার ছিলেন।
‘চিত্রলেখা’র আঠারোটা সংখ্যা বের হয়েছিল।
তারপর আর্থিক কারণে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকার সঙ্গে সম্পাদক
হিসাবে যুক্ত থাকার সময়ে নিজের বই সিনেমা হোক,এমন কল্পনা বিভূতিভূষণ করতেন কিনা জানা
নেই। তবে সমসাময়িককালে বিভূতিস্নেহধন্যা সুপ্রভা চৌধুরী (দত্ত)কে ‘পথের পাঁচালী’র অভাবী
লেখক মাঝে মাঝেই,কার কতহুলি বই সিনেমা হয়ে অভাব ঘুচেছে সে গল্প করতেন। এই সময় সুপ্রভা প্রশ্ন করতেন,তিনি কেন সিনেমার জন্য বই দেন না।
উত্তরে বিভূতিভূষণ নাকি বলতেন, ‘আমি যে সিনেমা হবে ভেবে কিছু লিখতে পারিনে। আর ‘পথের
পাঁচালী’ তো কেউ আর ছবি করবে না!’
কিন্তু, বিভূতিভুষণের জীবদ্দশাতেই ১৯৪৪
সালে ,সিগনেট প্রেসের ‘আম আঁটির ভেঁপু’র সচিত্র সংস্করণ অলঙ্করণ করতে করতে ডি যে কিমার
কোম্পানির এক তরুণ কমার্সিয়াল আর্টিস্ট ওই বই নিয়ে ছবি করারই স্বপ্ন দেখেছিলেন। এর
পরের ঘটনা ইতিহাস। যে বই নিয়ে বিভূতিভূষণ ছবি হবার কথা ভাবতেও পারেননি সেই বই নিয়ে
সত্যজিৎ রায়ের তৈরি ছবি হয়ে গেল বাংলা তখা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলস্টোন।
বিভূতিভূষণ অবশ্য তখন পরপারে।
রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০
গল্পঃ ছোটদের ছোট ছোটগল্প ( শেষ ধুতি)
শনিবার, ২৭ জুন, ২০২০
গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক (অটোগ্রাফের রবি)
গল্পঃ সাহিত্য/সাহিত্যিক
অটোগ্রাফের রবি
‘বাজে কথার ঝুলি/যতই কেন ভর্তি কর/ধুলিতে হবে ধুলি’। কিছু-কথা চেয়ে পাঠানো এক ভক্তের অটোগ্রাফ খাতায় রবীন্দ্রনাথ সেদিন খানিকটা রাগত
হয়েই লিখেছিলেন লাইন ক’টি। তার আগে পার্শ্ববর্তিনীকেও জানিয়েছিলেন উষ্মা-‘কি হবে রে কথা দিয়ে? কেবল কথা,কথা,কথা।’
করোনা আতঙ্কে কাঁপছে আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্ব। এরই মাঝে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের বুকের বলভরসা
হয়ে। কখনও ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর’,কখনও ‘দুবেলা মরার আগে মরব না’ উচ্চারণে। অটোগ্রাফের কবিতাটিও কিছুটা যেন স্পর্শ করে গেল এই ক্রান্তিকালে পালনীয়
ধর্মটিকে। কথা নয়, নয় অযথা কলরব,চাই শুধু কাজ।
অটোগ্রাফের খাতায় কবিতা অবশ্য এটাই
একমাত্র নয়। ‘ডেস্কেতে দেখিলাম,মাতা/রেখেছেন অটোগ্রাফ-খাতা।’ রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন এমন লাইন(‘অটোগ্রাফ’/রবীন্দ্রনাথ)। রানী চন্দের লেখা থেকে জানা যায় ভক্তের আবেদনে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কখনও
শুধু অটোগ্রাফ,কখনও বা দু এক ছত্র কবিতা সহ স্বাক্ষর রোজই দিতে হত প্রচুর।
সেলফির যুগে অটোগ্রাফের মাহাত্ম্য
বোঝা কঠিন। যদিও এ যুগেও অটোগ্রাফ প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি
পুরোপুরি। এখনও বইমেলায় বিখ্যাত লেখকদের নিজের বইতে দেদার অটোগ্রাফ বিলোতে দেখা যায়। কিন্তু আলাদা করে অটোগ্রাফ খাতা রাখার চল অনেক পুরোনো ভালো
অভ্যেসের মতই এখন অনেকটাই আমাদের স্মৃতির
পাতায়।
বিখ্যাত মানুষের অটোগ্রাফ মানে
তাঁর শরীরী উ্পস্থিতির মত একটা ব্যাপার। সে কাজটা মোবাইল যদি সেলফির মাধ্যমে
করে দেয় তো কে আর অটোগ্রাফের ঝামেলায় যায়! কিন্তু অটোগ্রাফ তো অনেক ক্ষেত্রে কেবল,বিখ্যাত মানুষটির স্বাক্ষরেই মিটে
যায় না। ভক্তদের জন্য দু একটি অমূল্য কথা বিখ্যাত মানুষটি
কখনও স্বেচ্ছায়,কখনও অনুরোধে লিখেও দেন। সেসব কথা কখনও ভক্তের জীবনে রয়ে
যায় মহার্ঘ্য সঞ্চয় হয়ে। আবার বিখ্যাত মানুষটি রবীন্দ্রনাথ হলে,সেসব কথা ভিন্ন ভাবে প্রাসঙ্গিকও
হয়ে যায় কখনও।
‘ছেলেবেলায় আমারও একটি অটোগ্রাফ খাতা ছিলো এবং রবীন্দ্রনাথ যেবার ঢাকা
গিয়েছিলেন,আরো অনেকের সঙ্গে তাঁর প্রসাদ-কণিকা আমিও পেয়েছিলাম। লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করি যে খাতাটি আমি বহুদিন হলো হারিয়ে
ফেলেছি,কিন্তু কবিতাটি আমার মনে আছে।…বাজে নিশীথের নীরব ছন্দে/বিশ্বকবির দান/আঁধার বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে/তারার বহ্নি গান।’ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু।
গৃহবন্দী জীবনে দিনে ব্যালকনি বা
বারান্দা আর রাতে ছাদ বা উঠোন এই তো এখন আমাদের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র। ব্যালকনি বা
বারান্দায় কাজ ছাড়া একটু আধটু দাঁড়ানো হলেও ছাদ বা উঠোনে এই বন্দীত্ব না এলে আমরা
কে আর কবে রাত্রিতে দাঁড়িয়েছি! আর শুধু দাঁড়ানোই তো নয় ,করোনার করাল ছবি
থেকে মুখ ফেরাতে এখন রীতিমত চলছে
প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরাও। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘আঁধার বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে’ ‘তারার বহ্নিগান’ও কি আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না এসময়!
‘যখন ছোট ছিলাম’ বইতে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ সহ কবিতা সংগ্রহের কাহিনি। সত্যজিৎ রায়ের তখন বছর দশেক বয়স। মায়ের সঙ্গে গিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। পৌষমেলায় বালক সত্যজিৎ কিনলেন একটা অটোগ্রাফ খাতা। ভীষণ শখ প্রথম পাতাতেই রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটা কবিতা লিখিয়ে নেওয়ার। এক সকালে মায়ের সঙ্গে গেলেন উত্তরায়ণে। খাতাটা রবীন্দ্রনাথকে দিতে,তিনি বললেন
পরের দিন সকালে খাতাটা নিয়ে যেতে।
পরদিন মায়ের সঙ্গে খাতা আনতে গিয়ে
পেলেন কাঙ্ক্ষিত জিনিস। রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছেন আট
লাইনের একটি কবিতা। সে কবিতা আজ প্রায় সবার জানা।‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখতে গিয়েছি পর্ব্বতমালা/দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু…।’কবিতার নিচে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর।আর তারিখ-৭ই পৌষ,১৩৩৬।
আটলাইনের কবিতাটি কিন্তু আসলে শিকড়ে
ফেরার কবিতা। ঘরের দিকে তাকানোর আহ্বান। ধানের শিষের ডগার শিশিরবিন্দুটি
নিশ্চয়ই তাজমহল নয়,কিন্তু উপভোগের বিচারে সেও তুচ্ছ নয়। তাকে নিয়েও মেতে ওঠা যায়,মেতে থাকা যায়!
যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরে এলেন এই
সময়টাতে,কিম্বা যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরে আসতে চেয়ে পারলেন না যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়,তাঁরা কেউওই এমনি পড়ে থাকেন না
বিদেশে। কিন্তু এই মহামারীর প্রভাবে তাঁদের না হোক,আগামী প্রজন্মের দৃষ্টিটা একটু
রাজ্যমুখী বা দেশমুখী,সার্বিকভাবে না হলেও কিছুটা কি হতে পারে না! মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়,খাটো কাজ মাথায় তুলে নিয়ে তাঁরা
অনেকে কি লেগেও যেতে পারে না নতুনভাবে
দেশগঠনে!
বিপদের দিনে বিপদের কথা বেশি ভাবলে
বিপদ কমে না। বরং বিপদ উত্তীর্ণ সময়ের একটা উজ্জ্বল স্বপ্ন কিছুটা হলেও শঙ্কার বোঝাটা হালকা করে দেয়। তাই ভাবা যেতেই পারে বঙ্গভঙ্গের উত্তাল সময়ে যে স্বদেশি আন্দোলন ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক,এবার তাকে দেখা যাবে পরিপূর্ণভাবে,একেবারে গ্রাম শহর ব্যাপী। সস্তার চটকদারিতে ভুলে ঢের কেনা হয়েছে বিদেশি দ্রব্য। হয়ত এবার শুরু হবে উল্টো পথে হাঁটা। হোক না একটু প্রযুক্তিতে দুর্বল, হোক না প্রাথমিকভাবে একটু বেশি
মূল্যের,তবু দেশের কুকুর বিদেশের ঠাকুরের চেয়ে যে বেশি গ্রহণীয় তা হয়ত এবার সাব্যস্ত
হবে সর্বব্যাপী। খুবই কি কষ্ট কল্পনা? আমার তো মনে হয় সত্যজিৎ রায়ের অটোগ্রাফ খাতায় লেখা কবিতাটি এই অসময়ে যেন এরকমই আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের এরকম অটোগ্রাফের কবিতা আরও আছে। রবীন্দ্রনাথের দু ছত্র লেখা সমেত সই চেয়ে প্রতিদিন যে অজস্র অটোগ্রাফ খাতা আসত এবং রবীন্দ্রনাথ পূরণও করতেন সেইসব খাতায়
ভক্তদের দাবি,সেগুলো তো কম নয়। তবে এর বেশিরভাগই হয়ত থেকে গেছে
হদিশহীন ব্যক্তি-মানুষের সম্পত্তি হয়ে। রানী চন্দ লিখেছেন-‘এই আমারই হাত দিয়ে কত অটোগ্রাফ-খাতা এসেছে গেছে-কত লোকের। সে-সব কবিতা এমনিই চলে গেল। লিখে রাখিনি কখনো…অনুতাপ জাগে মনে ক্ষণে ক্ষণে।’
অটোগ্রাফের সব কবিতা সংগৃহীত হলে
তা দিয়ে হয়ত একটা মূল্যবান সংকলনও হতে পারত। আর আমরাও হয়ত সেই আলোতেও এই ভাঙনকালের নিরাময়ের গল্পকে আরও একটু
প্রসারিত করতে পারতাম। নানভাবেই তো রবীন্দ্রনাথকে দেখতে
চায় বাঙালী। এখানেও হয়ত
ভক্তের বারান্দা থেকে এক অন্য রবীন্দ্রনাথ উঠে এসে দাঁড়াতেন আমাদের সামনে।
শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০
কথাঃ আবোলতাবোল (বাঁকা কঞ্চি)
কথাঃআবোলতাবোল
বাঁকা কঞ্চি
সময়টা যদি হয় সকাল দুপুরের মাঝামাঝি আর কালটা যদি হয় গ্রীষ্ম
তবে গ্রামের পথে বে্রোনো ছোট ছেলেটার হাতে
একটা বাঁকা কঞ্চি থাকা মানেই তো সে দিগ্বিজয়ী বীর। অন্তত সেরকমই ছিল আমাদের সময়টায়।
তখন মর্নিংস্কুল থেকে বাড়ি ফিরে গরমভাতে উদরপূর্তি আর তার
পরেই সটান রাস্তায়। দৌড় দৌড় দৌড়। আর দৌড়ের সঙ্গী অবশ্যই
একটা বাঁকা কঞ্চি।
বাঁকা কঞ্চিরও তখন অভাব ছিল না। এখানে বাঁশবন, ওখানে বাঁশবন।
বাঁকা কঞ্চি দিয়ে কখনও বাতাস কাটতাম,কখনও
অকারণে রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ের উপর শাসন চালাতাম আবার কখনও বাঁকা কঞ্চিটা শূন্যে তুলে
ধরতাম তরবারির কায়দায়।
সেসময় পুরাণ ইতিহাসের সন তারিখ সব সরিয়ে
রেখে কখনও কর্ণ হয়ে যুদ্ধ করতাম ক্লাইভের সঙ্গে, কখনও পৃথ্বীরাজ হয়ে সেলুকসের সঙ্গে।
হয়তো বাঁকা কঞ্চিরই মায়াবী পরশ,তাই কল্পনা আর বাস্তবের সীমারেখাটা সে-সময় মুছে যেত
অনায়াসে।
পাঁচমুড়ো পাহাড় আর শ্যামলী নদীর তীরে
বাস করা দইওয়ালারা বাড়ির সামনে দিয়েই হেঁকে যেত, ’দই,দই,ভাল দই’। পিপাসার্ত পথিকটি ‘জল পাই কোথায়’
বলে নাকাল হয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাতেই ঘোরাঘুরি করত। গরিব মুচির জুতো সারানো
ভূতেদের দেখা পাওয়া যেত আমাদের চারপাশে। বাড়ির দেবস্থানে সযত্নে রাখা জোড়া খড়ম শ্রীরামের
পাদুকা হয়ে আমাদের পুজো পেত।
গুরুজনেরা ধমক দিতেন-‘কী এক খেলা হয়েছে
কঞ্চি নিয়ে! চোখে যখন বিঁধবে বুঝবে মজা।’
গুরুজনদের কথা শুনতে তখন বয়েই গিয়েছে।
বাঁকা কঞ্চি হাতেই থাকত শৈশব জুড়ে,কল্পনার বাহন হয়ে।
বাঁকা কঞ্চির সেই বর্ণময় শৈশব এখন শুধুই
স্মৃতি।
এখন গ্রীষ্ম আসে,মর্নিং স্কুলও যথারীতি
আসে এবং এক বুক নির্জনতা নিয়ে জেগে থাকে বাঁশবনও। কিন্তু বাঁকা কঞ্চি হাতে নিয়ে গ্রামের রাস্তায় দৌড়য় না কোনও
শিশু।
এখন যেদিকে,যখনই চোখ মেলি,দেখি তিনটে
কাঠি পুঁতে শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেট। বাঁকা কঞ্চি অনাদরে পড়ে থাকে বাঁশবনের আনাচে কানাচে।
কেবল এক আধ সময় গাছের মগডাল থেকে জাম
অথবা লিচু পাড়তে তুলে নিই অনাদরে পড়ে থাকা কোনও কোনওটা। তারপর কাজ শেষে আবার ওটা ছুঁড়ে ফেলি যথাস্থানে। তবে কঞ্চিটা ফেলতে গিয়ে কিন্তু
টের পাই, মুচড়ে মুচড়ে উঠছে বুক।
বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন, ২০২০
গল্পঃ ঘুড়ি
ছোটদের গল্প
ঘুড়ি
ঘুড়িটা কাটা পড়েছে। তিনদিন হল।কাটা ঘুড়িটা ঝুলছে পবনদের শ্যাওড়া গাছে। কিন্তু কাটা ঘুড়িটা নিয়ে আসায় কোনও গা নেই তিলুর। বিকেলবেলায় বাড়ির সামনের ছোট্ট মাঠটায়
তিলুর ঘুড়ি আজ তিনদিন নেই। তবু ঘুড়ি-অন্ত প্রাণ ছেলেটা চুপচাপ।
কাটা ঘুড়িটা এমনকিছু উপরে নেই শ্যাওড়াগাছের। ইচ্ছে করলে ওটা নামিয়ে আনাই যায়। নামিয়ে এনে আবার মেরামত করে বিকেলে
ওড়ানোই যায়। কিন্তু মেরামতের জন্য খরচ আছে। সুতো সব ছিঁড়েখুড়ে একশা। কে দেবে মেরামতের খরচ!
দাদু থাকলে ভাবতে হত না। কিন্তু দাদু এখন আকাশে তারা। বাবার কীই বা রোজগার! দাদুর পেনশনের টাকাতেই সংসার চলত। এখন সংসারটাই চলছে না,তো ঘুড়ি!
পবনের ঠাকুমা মাঠে বসে ছেলেদের খেলা
দেখে। দেখে তিলুর ঘুড়ি ওড়ানোও। পবনের মত তিলুও তাঁকে ঠাকুমাই ডাকে। ঠাকুমা আজ বিকেলে তিলুকে চুপচাপ মাঠে
বসে থাকতে দেখে বলে-‘কী রে নাতি,তোর ঘুড়ি দেখছি না আকাশে!’
তিলু আঙুল দিয়ে শ্যাওড়াগাছটা দেখায়।
-‘খুব উঁচুতে তো নয়! পেড়ে নিয়ে যেতে পারছিস না?’
পেড়ে নিয়ে গেলেই যে ওড়ানো যাবে না,ঠাকুমাকে বলে কী লাভ! তিলু আর কথা না বাড়িয়ে বাড়িতে ফেরে।
দাদুর কথা আজ খুব মনে পড়ে তিলুর। কত ঘুড়িই যে দাদু কিনে দিয়েছেন তিলুকে! তা দেখে শুধু পবন নয়,পবনের ঠাকুমা সুদ্ধ তিলুকে টিপ্পনি কাটত-‘পেয়েছিলি একখানা নাতি-অন্ধ দাদু! একটা ঘুড়ি ছিঁড়তেই
আর একটা ঘুড়ি রেডি।‘
ওরা একটু বাড়িয়েই অবশ্য বলত। অতটা বেহিসেবি তিলু নয়। ঘুড়ি ছিঁড়লে ও অনেকবার আঠা দিয়ে নিজে
মেরামত করত। সুতোও গিঁট দিয়ে জোড়া দিত। কিন্তু এবার ঘুড়িটা কিছুটা আস্ত থাকলেও
সুতো আর গিঁট দিয়ে জোড়া অসম্ভব। সুতোর প্রায় পুরোটাই গায়েব। কোথায় ছিঁড়ে পড়ে আছে বলা মুশকিল।
সন্ধেবেলায় পবন তিলুদের বাড়ি পড়তে আসে। মা পড়ায়। পবন এক ক্লাশ উপরে পড়ে তিলুর। সেদিন পবন এসেই তিলুর মাকে বলে-‘ঠাকুমা এই রচনার পুরোটাই বলে দিয়েছে। ঠিক হয়েছে কিনা জানাতে বলেছে তোমাকে।’
পবনের ঠাকুমার বিদ্যে বেশি নয়। ফাইভ। কিন্তু জ্ঞান প্রচুর। পবনের বাংলা রচনায় মাঝে মাঝেই ঠাকুমার অবদান থাকে। কোনওদিন ঠাকুমার অবদানের প্রশংসা ছাড়া
তিলু অন্যকিছু বলতে শোনেনি মাকে। আজ পুরোটা ঠাকুমার বলা শুনে মা শুধু প্রশংসাই করে না,জোরে জোরে পড়েও যায় রচনাটা। রচনাটা কানে ঢুকলেও তিলুর আজ এসবে তেমন গা নেই। এখনও ও দাদুর কথাই ভেবে চলেছে।
কাটা ঘুড়িটা আনবে না মনে করেও পরদিন
স্কুল থেকে ফিরে তিলু আনতে যায়। কারণ পবন কাল পড়তে এসে বলেছে,হাজরাদের একটা ছেলে নাকি ঘুড়িটা নিয়ে
যাবার তালে রয়েছে। ঘুরঘুর করছে আশেপাশে। পারছে না ঠাকুমার জন্য।
ঘুড়িটা যতটা নিচে ভেবেছিল তিলু ততটা
নিচে কিন্তু নয়। সেভেনের সবচেয়ে লম্বা ছেলে ও। তবু বার কয়েক লাফাতে হল তিলুকে ঘুড়িটা পাড়ার জন্য। অবশেষে সফল। ঘুড়িটা পেড়ে ও পড়েও গেল মাটিতে। ধুলো ঝেড়ে ঘুড়িটা মাটি থেকে তুলতে যাবে,এমন সময় ওর চোখ বড় হয়ে গেল বিষ্ময়ে। ঘুড়িটায় পিন্ দিয়ে আটকানো আছে একটা
কুড়িটাকার নোট। শুধু তাই নয়,ঘুড়িটার গায়ে লেখা রয়েছে একটা চিঠিও।
‘তিলু,তুমি কি জান, তুমি ঘুড়ি
ওড়ালে আমি রোজ নেমে আসি
আকাশের অনেকটা নিচে!আজ তোমার ঘুড়িটার ওড়া
দেখেই বুঝেছিলাম ওটা
খুব খারাপভাবে ছিঁড়বে। তাই আটকে গেলাম টাকাটা। তুমি ঘুড়ি না
ওড়ালে আকাশে দাদুটা কি খুশি
থাকতে পারে! তোমার ঘুড়িই তো আমাদের দুজনের যোগসূত্র। যত তাড়াতাড়ি পার
মেরামত করে আকাশে ওড়াও ঘুড়িটা ।-তোমার দাদু।’
দাদুর চিঠিটা পড়ে তিলুর চোখের কোনে
চিকচিক করে। কিন্তু সত্যি এই টাকা,চিঠি সব দাদুর কাজ! দাদুর হাতের লেখা এতটা কাঁপা কাঁপা
হয়ে গেছে! হতেও পারে। কিন্তু ‘যোগসূত্র’ কথাটা তিলুর কেমন চেনা চেনা লাগে। কোথায় যেন শুনেছে। হঠাৎ তিলুর মনে পড়ে যায়। কাল সন্ধেয় মা পড়ছিল। পবনের ঠাকুমার লেখা রচনায় ছিল কথাটা।