রবিবার, ১৪ জুন, ২০২০

প্রিয় লেখক (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)


 সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

 

আমি যত্ন করিয়া লিখি,লেখাকে চিত্তাকর্ষক করিবার চেষ্টা করি তাই প্রথম পাঠে বোধহয় লেখার চাকচিক্যই চোখে পড়ে চাকচিক্য ছাড়া তাহাতে যে আর কিছু আছে তাহা কেহ লক্ষ্য করেন না অনেকে পরে আবার লেখাটি পড়িলে তাহার অন্তর্নিহিত বস্তুটি চোখে পড়ে

নিজের লেখা সম্পর্কে ডায়েরিতে একথা লিখেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তারিখ ৪ঠা জানুয়ারি,১৯৫২ ওই একই লেখায় তিনি জানিয়েছিলেন,তাঁর লেখা পাঠকদের আকৃষ্ট করার কারণ,তাতে রয়েছে একটা immediate appeal যা মোহিতলালের ভাষায়ত্বরিতানন্দ

আসলে একজন লেখক টিকে থাকেন লেখার মধ্যে দিয়ে নিজের বিশ্বাস,আদর্শকে সঠিক সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করার মাধ্যমে একেই হয়ত শরদিন্দু বলতে চেয়েছেন লেখারঅন্তর্নিহিত বস্তু এইঅন্তর্নিহিত বস্তু গোয়েন্দা  কাহিনি বা ভৌতিক কাহিনিতে সেভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় না এরজন্য দরকার পড়ে অন্যধরণের লেখা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এই অন্য ধরণের লেখা হল ইতিহাসের কাহিনি এর  মধ্যেই তিনি তাঁর জীবনচেতনা পরিস্ফুট করার চেষ্টা করেছেন।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখি শুরু হয়েছিল ১৯২৯ সালে আর তাঁর জন্ম সেই বাংলাসাহিত্যের জন্য খুব পয়মন্ত সাল ১৮৯৯ ১৮৯৯ সালটি পয়মন্ত কেননা এই সাল  ধারণ করে আছে শরদিন্দুর সঙ্গে  জীবনানন্দ নজরুলের জন্মতারিখ শরদিন্দু জন্মেছিলেন ৩০ মার্চ,উত্তর প্রদেশের জৌনপুর শহরে বাবা তারাভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মুঙ্গেরের ডাকসাইটে উকিল ম্যাট্রিক পাশ করেই শরদিন্দু চলে আসেন কলকাতায় কলকাতায় কেটেছে ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল অব্দি বিএ পাশ করেন কলকাতা থেকে, তেও ভর্তি হন কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইন পাশ করেন পাটনা থেকে

কবিতা দিয়ে সাহিত্যের যাত্রাপথ শুরু একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ করেন-‘যৌবন স্মৃতি পাকাপাকিভাবে লেখায় আসেন ১৯২৯ সালে ছোটবেলা থেকেই ডিটেকটিভ গল্পের পোকা ছিলেন দেশি বিদেশি গোয়েন্দা কাহিনি গিলতেন গোগ্রাসে কলকাতায় পড়াকালীন শহুরে মানুষজনকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছেন লিখতে এসে  ভাবলেন,গোয়েন্দা কাহিনি লিখলে কেমন হয় লিখতে পারবেন, বিশ্বাস ছিল ১৯৩৩ শুরু করলেন প্রথম গল্পপথের কাঁটাদিয়েপথের কাঁটাসহ প্রথম তিনটি গল্প ছাপা হলমাসিক বসুমতীতে বাংলা সাহিত্যের পাঠক সাদরে গ্রহণ করল গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীকে নিজে বন্দ্যোপাধ্যায়,কিন্তু গোয়েন্দা বক্সী, নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মজা করে বলেছিলেন-‘আমার ধারণা কায়স্থরা ব্রাহ্মণদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরে

শরদিন্দুর গোয়েন্দা কাহিনি তাঁর লেখার প্রসাদগুণে নিছক গোয়েন্দা-কাহিনি হয়ে থাকল না হয়ে উঠল সামাজিক উপন্যাস কিন্তু তবু,শুধু গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে শরদিন্দুর মত শক্তিশালী লেখক এগিয়ে যাবেন,তা হতে পারে না গোয়েন্দা কাহিনির পাশে ছোটবেলা থেকেই শরদিন্দুর প্রিয় ছিল ঐতিহাসিক কাহিনি  রমেশচন্দ্র দত্তেররাজপুত জীবন সন্ধ্যা’, ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাতপড়েছিলেন মুগ্ধ হয়ে এরপর   বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে অভিভূত হয়ে গেলেন গোয়েন্দা কাহিনির পাশাপাশি এবারে চলল পুরোদমে ঐতিহাসিক উপন্যাস,গল্প লেখা শরদিন্দুশরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন-‘ইতিহাসের গল্প লিখেই বেশি তৃপ্তি পেয়েছি মনে কেমন একটা সেন্স অব ফুলফিমেন্ট হয়

 কিন্তু কেমন হল তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস? সুকুমার সেন লিখেছেন-‘আগেকার লেখকদের মতো  শরদিন্দুবাবু দূরবীনের চোঙার মধ্য দিয়ে কিম্বা নাকে দূরদৃষ্টির চশমা এঁটে ইতিহাস হাতড়াননি বা খোঁজ  চালাননি ইনি যেন চোখে কন্ট্যাকট লেন্স লাগিয়ে ইতিহাসকে হাতের নাগালে পেয়েছিলেন দূরের দৃশ্যপটকে নিকটে এনে দূরের মানুষকে কাছের করতে পেরেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

 সত্যিই তাই যেজন্য যে ঐতিহাসিক কাহিনি বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে একদা বর্ণময় হয়েছিল,শরদিন্দুর হাতে তা হল গল্পময় স্বাভাবিকভাবেই গল্পপ্রিয় বাঙালি তাঁর ঐতিহাসিক রচনা গ্রহণ করল পরম সমাদরে শুধু সেদিন নয় ব্যোমকেশ- কাহিনির পাশে বাঙালি আজও পড়ে তাঁরগৌড়মল্লার’ ‘তুঙ্গভদ্রার তীরেইত্যাদি ঐতিহাসিক রচনা সাধারণত গোয়েন্দা-কাহিনির লেখকদের গোয়েন্দার জনপ্রিয়তায় চাপা পড়ে যায় তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকীর্তি যেমনটা হয়েছিল দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ক্ষেত্রে  দীনেন্দ্রকুমারের রবার্ট ব্লেকের গোয়েন্দা কাহিনির জনপ্রিয়তার আড়ালে তাঁর জীবদ্দশাতেই লোকে বিষ্মৃত হয়েছিল তাঁর অনুপম সাহিত্যকীর্তি-‘পল্লীচিত্র’, ‘পল্লীবৈচিত্র্য সুখের কথা,শরদিন্দুর ক্ষেত্রে তা হয়নি

১৯৩৮ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বোম্বে পাড়ি দেন চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্য লেখার কাজ নেন ১৯৫২ সালে সিনেমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন লেখায় পাকাপাকি বাস করতে থাকেন পুণায়

যে কোনও গোয়েন্দা কাহিনির লেখক তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দাকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসেন লেখকের ভাব-ভাবনা অনেকটাই গোয়েন্দাটি বহন করে থাকে একবার প্রতুল চন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের  সরস পত্রালাপ হয়েছিল ব্যোমকেশকে গাড়ি দেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে এই সরস পত্রালাপ প্রতুল চন্দ্র গুপ্ত লিখে গেছেন সেখানে দেখা যায় ব্যোমকেশকে নিয়ে তাঁর পিতার মতই চিন্তাভাবনা ব্যোমকেশকে গাড়ি দিতে  লেখক প্রথমে রাজি  হচ্ছিলেন না সত্যবতীর ডিমান্ড বেড়েই চলেছে,ব্যোমকেশের হাত  দেখেছি-ওর বরাতে গাড়ি নেই ইত্যাদি নানান অজুহাত খাড়া করছিলেন শেষ অব্দি একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি দেবার ব্যাপারে রাজি হন লেখা শুরু করেনবিশু পাল বধগল্প কিন্তু সে লেখা অসমাপ্ত রেখেই লেখক পাড়ি দেন অমর্ত্যলোকে তারিখটা ১৯৭০ এর ২২শে সেপ্টেম্বর   

 


৩টি মন্তব্য:

  1. অনেক সুন্দর লেখা।বেশ ঝরঝরে গদ্য।

    উত্তরমুছুন
  2. অনেক সুন্দর লেখা।বেশ ঝরঝরে গদ্য।

    উত্তরমুছুন
  3. শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সমন্ধে খুব অল্প পরিসরে অনেক সুন্দর লেখা তুলে ধরেছেন স্যার। খুব ভালো লাগলো। নতুন নতুন জিনিস জানতে পারলাম। এরকম আরও লেখা চাই স্যার।

    উত্তরমুছুন