ভালো থাকুক শিশুরা
খবরে প্রকাশ, শিগগির খুলছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছাত্রছাত্রীদের বন্দী জীবন বহাল
থাকছে জুনের পরেও অনির্দিষ্টকাল। এ
অবস্থায় পরিবার তথা জাতির ভবিষ্যতদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ
রয়েছে। বয়সে যারা একটু বড়,তারা হয়ত কিছুটা মানিয়ে নিতে পারে
এই অবস্থার সঙ্গে। কিন্তু এই দীর্ঘ বন্দীজীবন প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থী-শিশুদের
কাছে বেশ কষ্টের।
এমনিতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে
অনেক পরিবার এখনও কর্মসহায়িকার সাহায্য থেকে বঞ্চিত। সেখানে, একে তো করোনায় কী হবে
তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা,তার উপর বাবা মা দুজনেই জেরবার ঘরের
কাজ করতে গিয়ে। তাঁদের বিরক্তির গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া,অশান্তিও কমবেশি লেগেই রয়েছে। এর উপর বাড়ির শিশুর চাঞ্চল্য, দুষ্টুমি। সামলানো সহজ কথা নয়।
বাড়িতে শিশুদের সামলাতে এইসব পরিবারে এখন তাই তিনটিই প্রধান রাস্তা। এক, শাসন (যার মধ্যে প্রহার
একটা বড় অংশ)।দুই,পড়াশোনায় শিশুকে ব্যস্ত রাখা। তিন, একালের শিশুর প্রধান চাহিদার কাছে নতি
স্বীকার করে গেম খেলার জন্য মোবাইলটা বাড়িয়ে দেওয়া অথবা টিভিতে দীর্ঘক্ষণ কার্টুন দেখতে
অনুমতি দেওয়া। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো
কোনওটাই যে ঠিক নয়, উপরন্তু যথেষ্ট ক্ষতিকারক তা বলার অপেক্ষা
রাখে না।
বন্দীজীবনে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য
ঠিক রাখতে ডাক্তার বা মনোবিদেরা অনেক দাওয়াই দিচ্ছেন। সেগুলো তো রইলই,সঙ্গে আরও কিছু প্রস্তাব অভিভাবকেরা ভেবে দেখতে পারেন।
আমাদের ছেলেবেলায় যখন টিভি ছিল না,মোবাইল ছিল না,এমনকী অনেকবাড়িতে পাঁজি ছাড়া পড়ার বইয়ের
বাইরে কোনও বইও থাকত না,তখন লাগাতার বর্ষাবাদলে গৃহবন্দী হয়ে আমরা বেশ কিছু খেলা খেলতাম নিজেদের মধ্যে। এই খেলাগুলো যেমন আনন্দদায়ক,তেমনি মানসিক স্বাস্থেরও অনুকূল।
এইসব খেলার একটা ছিল ‘দেখাদেখির খেলা।’ এটা শুরু হত এইভাবে, একজন চারিদিক তাকিয়ে নিয়ে বলে উঠত, ‘আমি যা দেখি,তুই তা দেখিস? আমি দেখছি একটা প্রজাপতি।’ বলেই সে এক দুই তিন করে দশ গুনতে থাকত। সহখেলোয়াড়টি সঙ্গে সঙ্গে তাকাত আশে পাশে। প্রজাপতিটি তাকে দেখাতে হবে প্রতিপক্ষের দশ গোনার মধ্যে। পেরে গেলে তার দান। আর না পারলে,এক পয়েন্টে পিছিয়ে আবার প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জের সামনে।
এরকমই আর একটা খেলা ছিল, ‘আপ,ডাউন।’ এই খেলায় রাস্তার ধারের জানলায় বসত দুজন। রাস্তার একটা দিক আপ, আর একটা দিক ডাউন। দুজনের হাতেই থাকত দুটো কলম,আর কাগজ। ঘড়ি মিলিয়ে বসা হত। পনেরো মিনিট সময়। ওই সময়ে আপ থেকে কজন মানুষ এল,ডাউন থেকে কজন মানুষ এল, দুদিকের দুজন কাগজে লিখত এক দুই করে
। পনেরো মিনিট পরে আবার সাইড চেঞ্জ। আবার গোনা। এবার হিসাবের পালা। যার বেশি স্বভাবতই সে বিজয়ী।
ছুটির দিনের আর একটি মজার খেলা ছিল,’তুই কত,মুই কত।’ এখানে তৃতীয় একজন,দুই খেলোয়াড়েরই অসাক্ষাতে,গুলি পেনসিল পুতুল কাঁচি মিলিয়ে খান
পনেরো জিনিস ফাঁকা মেঝেয় রাখত। এরপর
দুজনকে ডেকে মিনিট
খানেক দেখতে দেওয়া হত জিনিসগুলো। দুজনের হাতেই দেওয়া হত কাগজ আর পেন। আলাদা আলাদা জায়গায় গিয়ে দুজনে লিখত সেগুলোর নাম। এই লেখার জন্যও সময় থাকত। সময় শেষ হতেই নিয়ে নেওয়া হত কাগজ। দেখা হত,কে কটা লিখতে পেরেছে।
তখনকার সাময়িক গৃহবন্দীত্বে অথবা ছুটির
দিনে শিশুদের এই খেলাগুলো নিজেদের মত করে আবার এখন চালু করাই যায়। পরিবারে দুটি শিশু না থাকলে বাবা অথবা মা যে কেউই হয়ে যেতে পারেন সহ খেলোয়াড়। বলা যায় না এতে বাবা মারাও নিজেদের
জন্য কিছুটা বাড়তি অক্সিজেন পেয়ে যেতে পারেন।
বাড়ির শিশুটিকে নিয়ে সবসময় এইসব খেলায়
মেতে থাকা নিশ্চয়ই অসম্ভব। তার দরকারও নেই। অভিভাবকেরা যখন ব্যস্ত,তখন শিশুদের নিয়োজিত করা যেতে পারে কিছু
অন্যরকম কাজে। আজকাল বেশিরভাগ বাড়িতে (সে বাড়ি ফ্ল্যাট হলেও) টবে ফুলগাছ একটা সাধারণ দৃশ্য। ঘরের শিশুটিকে এসময় একটি বা দুটি ফুলগাছে জল দেওয়ার কাজে
নিয়োজিত করা যেতে পারে। এ ছাড়া মোবাইল যদি তাকে দিতেই হয়, দেওয়া যেতে পারে এই সময়টাতেই। তবে গেম খেলার জন্য নয়। ইউটিউব দেখে কাগজের ফুল,পাখা,নৌকো কীভাবে তৈরি করা হচ্ছে তা শেখা এবং প্রয়োগের জন্য। একটা কাঁচি,কিছু রঙিন কাগজ দিয়েদিলেদিয়ে
দিলে সে কিন্তু খুশিমনেই এ কাজ করবে। কেননা, কাঁচি দিয়ে কাগজ কাটতে প্রতিটা শিশুই ভালোবাসে।
আঁকার কাজ শিশুরা করেই থাকে। এই সুযোগে তাকে লাগিয়ে দেওয়া যেতে
পারে নতুন কোনও দৃশ্য বা ফলফলারি আঁকার কাজে। নিয়মের বাইরে যে কোনও জিনিসেই শিশুর উৎসাহ । এরকম আঁকার কাজ দিলে হয়ত সে খুশি মনেই
সেটা করবে।
মাঠ নেই,ছাদ তো আছে। বিকালের দিকে ছাদের উপর শিশুকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। মাটি না পাক,আকাশ দেখলেও কিন্তু
মন ভালো হয়ে যায়। সরে যায় মনের মেঘ। রাতে ওই ছাদেই বাড়ির খুদেটির জন্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে,গুগুলকে সাথী করে বসানো
যেতে পারে আকাশ চেনার আসর।
পরিবারের বাইরে শিশুর পছন্দের জন কে
তা বাবা মার অজানা নয়।মোবাইলে সেই পছন্দের জনটিকে ধরে মাঝে
মাঝে কথা বলার সুযোগ করে দিলে শিশু খুশি হবে। এছাড়া কার্টুনের নেশা কাটাতে ছোটদের বই
ইউটিউব থেকে খুঁজে দু তিনদিন অন্তর দেখানো যেতে পারে। শোনানো যেতে পারে তাদের উপযোগী কোনও ভাল অডিও গল্প।
স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে টিফিনে হুল্লোড়, বিকেলে সবুজ মাঠে খেলার সাথীদের সঙ্গে
কলরব, কিম্বা মা বাবার সঙ্গে শপিংএ বেরিয়ে পছন্দের আইসক্রিম খাওয়া,কোনওটারই হয়ত বিকল্প হয় না। তবু শিশুকে ভাল রাখতে হবে যে কোনও উপায়ে। চেষ্টা করতেই হবে নানাভাবে যাতে এই
বন্দীজীবন তার কাছে দুর্বিষহ না হয়ে ওঠে ।
শিশুদের নিয়ে এত সুন্দর লেখা মন ভালো করে দিল। আবার ছোটবেলার সেই আনন্দঘন অকৃত্রিম খেলাধুলা গুলোর কথা মনে করে মন স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠলো।মনে হয় ছোটবেলায় কী ভালো নির্ভেজাল দিনগুলো না কাটিয়েছি কাজিনরা মিলে।দাদু দিদার বাড়িতে সবাই মিলে একজায়গায় হলে সে কী তুমুল হৈচৈ, চেঁচামেচি, দুরন্তপনা...! কত কিছু যে মিস করে যাই এখন!
উত্তরমুছুন