বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন, ২০২০

কথাঃ আবোলতাবোল (চেয়ার)

কথাঃআবোলতাবোল

 

চেয়ার

 

-প্লাস্টিকের চেয়ার নেবে?’  

পুরোনো কাগজ ওজন করতে করতে অল্প বয়সী ছেলেটা আমার প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘোরায়-‘ভাঙা?’

-‘একেবারে ভাঙা নয় এখনও বসা যায়

-‘দাম কিন্তু ভাঙারই পাবেন-কটা আছে?’

-‘কটা আবার? একটা।’

কাগজ ওজন প্রায় শেষ চেয়ার নেবার জন্য ঘরে ঢুকি কিন্তু বাধা আসে ভিতর থেকে–‘নতুন  না কিনে ওটা দিয়ে দিচ্ছ যে! এই সময়ে চেয়ার কিনতে নিশ্চয় বাইরে যাবে না!’  

এখন বাধাঅথচ চেয়ার বিক্রির তাড়া কিন্তু তার জন্যই কদিন আগে চেয়ারের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে শাড়ি ছিঁড়ে গিয়েছে ভাঙা জায়গায় আটকে

তবে এই পরিস্থিতিতে কথাটায় যুক্তি আছে কাগজ কেনার ছেলেটাকে কাগজের দাম বুঝে নিয়ে  বিদায় করি।

আমার বসার চেয়ারটা ভেঙেছে কিন্তু আজকে নয় আর তাতে যে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছে তাও নয় হেলান দেওয়ার অংশটায় দুপাশের দুটো জায়গা বসার অংশটা থেকে ছেড়ে গেছে এতে বরং আমার আরামই হচ্ছে প্লাস্টিক চেয়ারে বসে রিভলভিং চেয়ারের মজা পাচ্ছি

ভাঙা চেয়ারে দোল খেতে দেখলে বাড়ির আর একজনের চোখ অবশ্য কপালে ওঠে -‘এভাবে দোল খেলে,একদিন কিন্তু পড়বে হুড়মুড় করে!’

কথাটা হয়ত মিথ্যে নয় কিন্তু কম্পিউটারের সামনে বসে যখন কিছুই লেখার খুঁজে পাই না,তখন এপাশে ওপাশে দোল খেলে দেখেছি চিন্তাতেও দোলা লাগে মনেই আসে না,এভাবে দোল খেলে পড়েও যেতে পারি  

যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল, তখন কিন্তু চেয়ারটা অনেকবারই পাল্টানোর কথা হয়েছে আর আমি একেবারে গা করিনি তাও নয়

তবে এ ব্যাপারে আমার তো একেবারে বেহিসেবি হলে চলে না। আমি চাই দাম কম হবে,জিনিসও ভাল হবে। এই মন নিয়ে একবার বেরিয়েওছিলাম চেয়ারের সন্ধানে। কিন্তু চেয়ারের দাম আর আমার পছন্দকে এক জায়গায় আনতে পারিনি। অগত্যা এক দোকান থেকে নিয়ে এসেছিলাম চেয়ারের বিকল্প হিসাবে প্লাস্টিকের একটা টুল আমার কম্পিউটার টেবিলের কাছে ওটা নিয়ে বসতে গিয়ে দেখি আরেক সমস্যা।  কম্পিউটার মনিটরটাকে বিঘৎ খানেক তুলতে হবে কাজেই ওটা বাতিল হয়ে এখন ড্রইং রমে

একবার অ্যামাজনে একটা বেশ সস্তায় রিভলভিং চেয়ার দেখে অর্ডার দিয়েছিলাম কম্পিউটার টেবিলের  সামনের সংকীর্ণ জায়গায় ওটাকে রাখতে অসুবিধা হবে জেনেও

কদিন পরে রিভলভিং চেয়ার আসার পরিবর্তে এসেছিল চেয়ারে বসার কুশন আমি তাজ্জব কম্পিউটার  খুলে দেখি,সত্যি ওটা কুশনেরই ডিসপ্লে ছিল নাহলে পাঁচশো পঁচানব্বই টাকায়

-‘ভালো চেয়ার তোমার কপালে জুটবে নাদৈববাণীর মত সেদিন ভেসে এসেছিল রান্নাঘরের বাণী

কথাটা মাঝে মাঝে তলিয়ে ভেবে দেখি, আমার জীবনেও এর চাইতে বড় সত্যি আর কিছু নেই জুৎসই চেয়ারের ভাগ্য আমার সত্যি নেই

আমি তখন কাগজে ইতস্তত লিখছি যদিও বিশাল কিছু নয় কিন্তু তবু ছাপার অক্ষরে তো বটে!আর কাগজগুলোও খুব অনামা নয় সেসময় বাড়ি গেলে গ্রামের লাইব্রেরিতে যাওয়ার একটা অভ্যেস আমার ছিল সেবার সেখানে যেতেই লাইব্রেরিয়ান একগাল হেসে বললেন-‘এবার জানুয়ারির তেইশেতে নেতাজির উপর এসে কম্পিটিশন হচ্ছে তোমাকে আমারা এই কম্পিটশনে পেতে চাই

আমি আহ্লাদে গদগদ কিন্তু সে আহ্লাদ বেশিক্ষণ টিকল না কারণ,আমি ভেবেছিলাম থাকতে হবে জাজের  ভূমিকায় লাইব্রেরিয়ান বললেন-‘বেশি প্রতিযোগী হয়নি লিখে নিচ্ছি তাহলে তোমার নামটা!’

অল্প বয়সে চাকরিতে ঢোকার কারণে তিন জায়গা মিলে আমার বত্রিশ বছর চাকরি হয়ে গেল কিন্তু কোথাও বাড়তি চেয়ার তেমন কেউ দেয়নি এক জায়গায় আমার পদোন্নতি হয়েছিল ছেড়ে আসা অব্দি সে পদেই বহাল ছিলাম কিন্তু সে চেয়ারের অবস্থা আরও খারাপ ডিউটিতে গেলে বাড়তি দশ টাকা,না গেলে ফক্কা আবার রোজ গেলেও কোনওভাবেই মাসে বাড়তি দুশো টাকার বেশি নয়

আমাকে যখন এই চেয়ার দেওয়া হয়,তখন অনেককেই বিভিন্ন পদের চেয়ার দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেসব চেয়ারগুলো কিছুদিন যাবার পরেই পোক্ত হল,নড়বড়ে থেকে গেল শুধু আমারটাই এখন নেপোটিজম নিয়ে কত কথা শোনা যাচ্ছে কিন্তু এই নেপোটিজমের স্বাদই আলাদা স্বাদের ভাগ হবে না হ্যাঁ,বলতে ভুলে গেছি,ওটা কোনও বেসরকারি সংস্থা কিন্তু নয় খাঁটি সরকারি

পরের চাকরিতেও তথৈবচ যে কাজটা একটু আধটু পারি,সে কাজের ভার  কর্তৃপক্ষ আমাকে দিতে গেলেই আড়ালে ফিসফাস আমার অনুপস্থিতে কর্তৃপক্ষের কাছে দরবার ফলে আমার যা স্বভাব রাগ করে আমিই  ঠেলে দিয়েছি চেয়ারটা

চেয়ার নিয়ে এখন আর আমার কোনও আফশোস নেই এদেশে চেয়ারম্যান হতে গেলে যে যোগ্য হতে হয়, ধারণা আমার কাছে  ক্রমবিলীয়মান

ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে আমরা অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ছবি দেখতাম মাথাকাটা কনিষ্ক,সশিং আলেকজেন্ডার এরকমই আর একটা ছবি ছিল পিঠে চেয়ার নেওয়া হিউয়েন সাঙের এমন সব ছবির পিছনের আসল সত্যিটা আমাদের এখন জানা তবু ছেলেবেলার কম বুদ্ধিতে বোঝা,ওই চেয়ার-পিঠে হিউয়েন সাঙের ছবিটা আমার আজও কেমন সত্যি-সত্যি লাগে মনে হয়, ছবি নয়। মেসেজ। আর  একেবারে তা হক কথা এদেশে চেয়ার মেলা অত সহজ নয় তার চেয়ে একটা নিজের চেয়ার বানিয়ে নেওয়া ঢের ভাল।

  চেয়ার পুরোপুরি সেফ। এখান থেকে পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। নেই চেয়ার হারিয়ে যাবার ভয়ও। আর যেহেতু এ চেয়ারে দাক্ষিণ্যের চিহ্ন থাকে না, তাই এর সঙ্গে লেগে থাকে একটা গর্ববোধও। অন্যের কাছে শ্রদ্ধেয় হবার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনাও এ চেয়ারের রয়েছে।

বলা দরকার,এত সব ভাবনা কিন্তু ওই...মানে আমার ‘রিভলভিং’এ দোল খেতে খেতেই।  

 

 

 


২টি মন্তব্য: