রবিবার, ২১ জুন, ২০২০

গল্প (চোর)

                       



গল্প


চোর               

 

 

পালান সেখ চেঁচাচ্ছে–‘স্যাররা নিচে আসুন,নিচে আসুন চোর ধরা পড়েছে,সাইকেল চোর

আজ স্কুলে পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান ক্লাস নেই অনুষ্ঠান হবে স্কুলের হলঘরে স্যারেরা তাই  ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন কয়েকজন স্টাফরুমে  গল্পগুজব করছিলেন কয়েকজন চায়ের ঘরে,চা  খাচ্ছিলেন আর কয়েকজন স্কুলের  হলঘরে স্টেজের তদারকি করছিলেন হেডস্যার নিজের চেম্বারে বসেছিলেন জরুরী কিছু কাগজপত্র  নিয়ে 

পালান সেখের চীৎকারে সবাই দোতালার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান এই স্কুলের স্যারদের বসার ঘর,  হেডস্যারের চেম্বার, অনুষ্ঠানের হল,সবই দোতালায় স্যারেরা ব্যালকনিতে আসতে পালান আবার  উপরের দিকে তাকিয়ে চীৎকার করে-‘সাইকেল চোর ধরা পড়েছে,সাইকেল চোর 

সাইকেল চোর ধরা পড়ার খবর  হলঘরে সমবেত হওয়া ছেলেদের কানেও গিয়েছে ওরা হল থেকে বেরিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে হেডস্যারকে নিয়ে স্যারেরাও নিচে নেমে আসেন

অনেক কটা গ্রামের মাঝখানে এই স্কুল সাইকেল নিয়ে প্রচুর ছাত্রছাত্রী আসে আগে সাইকেল রাখার গ্যারেজ ছিল না এখন গ্যারেজ হয়েছে কিন্তু গ্যারেজ হলে কী হবে? গার্ডের ব্যবস্থা এখনও করা যায়নি গ্যারেজের একটা দিকে আবার প্রাচীরের অনেকটা  কিছুদিন আগে ঝড়ে ভেঙে গেছে এখনও  সারানো হয়ে ওঠেনি সাইকেলগুলো তাই গ্যারেজে থাকলেও খুব সুরক্ষিত থাকে না স্কুলগেটের পাহারাদার পালান সেখ গেটের সঙ্গে গ্যারেজটা দেখার দায়িত্বও পালানের উপর চাপানো হয়েছে  কিন্তু তারও তো দুটোই চোখ গেট সামলে অনেক সময়ই গ্যারেজের দিকটা দেখায় ফাঁকি থেকে যায় ফলে উটকো লোক গ্যারেজে মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ে ঘটে সাইকেল চুরির ঘটনাও

সাইকেল চোর  কিন্তু একটাকেও এখনও ধরা যায়নি আজ সাইকেল চোর ধড়া পড়ায় ছাত্রেরা সকলেই উত্তেজিত

কিছু ছাত্র নিচে ছিল,তখনও হলঘরে যায়নি চোরকে ধরেছে তারাই তবে গেমসের অর্ণবস্যার কাছেপিঠেই ছিলেন তাই চোরের উপর ওদের মারটা দু একটা কিল চড়ের বেশি এগোয়নি

সাইকেল চোরকে গ্যারেজের কাছের শিমুলগাছটার তলায় বসিয়ে রাখা হয়েছে বেড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্রেরা 

স্যারেদের নিয়ে হেডস্যার ওখানে পৌঁছতেই উঁচুক্লাসের কয়েকজন ছাত্র আওয়াজ তুলল-‘ওকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন স্যার এতদিন যত সাইকেল চুরি গেছে সব কটার শোধ তুলব ওর পিঠে

হেডস্যার ছেলেদের কথার জবাব দেবেন কি  সাইকেল চোরকে দেখেই তো চক্ষু চড়কগাছ এতটুকু  ছেলে সাইকেল চুরি করছিল! বয়স খুব বেশি হলে তেরো হবে

বাংলার রফিকুল স্যার প্রস্তাব দেন-‘থানায় দিয়ে দিন,যা করার ওরাই করবে   

ছেলেটার একেবারে কাছে দাঁড়িয়েছিলেন অর্ণবস্যার ছাত্রদের কিলচড়ের এক-আধটা ছেলেটার মুখে পড়েছেএকটু ফুলেও গেছে মুখটাসেদিকে একবার তাকিয়ে হেডস্যারকে উনিও বলেন-‘থানায়ই দিয়ে দিন ওকে

হেডস্যার কিন্তু কোনও কথা বলছেন না বোঝা যাচ্ছে না তিনি ছেলেটাকে নিয়ে কী করবেন

-‘কী নাম তোর?’ বেশ কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভাঙলেন হেডস্যার

-‘পুষ্করমৃদুস্বরে জবাব দিল সাইকেল চোর

-‘তুই গ্যারেজে কী করছিলি একটু বলবি?’ হেডস্যার তাকান পুষ্করের দিকে

হেডস্যারের প্রশ্নে মাস্টারমশাইদের মধ্যে চাপা হাসি খেলা করে একজন বলেই বসেন-‘গ্যারেজে সাইকেল  চোর সাইকেল চুরি করছিল এটা আবার শুধোনোর কী আছে 

চোর কিন্তু মাথা নিচু করে জবাব দেয় -‘গ্যারেজে ঢুকে সাইকেল চুরি করছিলাম একেবারে কোনার সাইকেলটা নিয়ে প্রাচীর টপকাচ্ছিলাম একটা বড় ছেলে গিয়ে ধরে ফেলল

-‘এর আগে এখান থেকে আর কটা সাইকেল সরিয়েছিস?’ হেডস্যারের গলা এবার বেশ তীক্ষ্ণ

-‘আজই প্রথম বিশ্বাস করুন

-‘চোরকে আবার বিশ্বাস!’ ইতিহাসের মৃদুলা ম্যাম গজগজ করেন  

-‘বাড়িতে কে আছে তোর?’ শুধোন হেডস্যার

-‘কেউ না 

-‘তাই হয় নাকি? মিথ্যে বলছিস বাড়িটা কোথায় বল তো! খোঁজ নিচ্ছি আমরা

এবার ছেলেটা ফিক করে হেসে দেয় সবাই তাজ্জব–‘হাসছিস যে!’ পিছন থেকে এগিয়ে এসে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড ধমকে ওঠেন

ছেলেটার মুখে তবু হাসি বলে-‘বাড়িই তো নেইস্টেশনে থাকি

-‘কী করিস স্টেশনে?’

-‘লোকের মাল বয়ে দিই,পয়সা নিই আর যেদিন কিছু না হয়, সেদিন টুকিটাকি চুরি আজ স্কুলের পাশ  দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম যদি একটা সাইকেল

-‘কেমনভাবে নিজের কথা বলছে,দ্যাখো! একটুও ভয়ডর নেই!’ভূগোলের দীপ্তি ম্যাম  চোখ বড় বড়  করেন

-‘তাহলে আর কী, চল তোকে থানায় দিয়ে আসি,ওরাই তোর বিচার করুকহেডস্যার বলে ওঠেন

 

 থানাটা কাছেউঁচু ক্লাশের ছাত্রেরা বলে-‘স্যার থানায় আমরাও যাব সবাই মিলে থানায় গেলে থানা চট করে ওকে ছাড়বে না নাহলে নাবালক বলে ছেড়ে দিতে পারে

-‘কথাটা ঠিক তা বেশ যাস তোরা এখন সবাই অনুষ্টানের ঘরে চল ভুলে যাসনি তো সবাই যে আজ পঁচিশে বৈশাখ!

ছেলেরা কিছু বলার আগে অ্যাসিস্ট্যান্ট হে্ড বলেন-‘এই ব্যাপারটা চুকিয়ে গেলে হতনা?’  

হেডস্যার বলেন –‘না,না আগে অনুষ্টানটা সেরে নিই

আর কথা চলে না সবাই হলঘরে উঠে আসে সাইকেল চোরকেও আনা হয়েছে একেবারে সামনের একটা বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছে

অনুষ্ঠান শুরু হয় প্রথমে হেডস্যার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দু-চার কথা বলেন। তারপর শুরু হয় অন্যকিছু।  ফাইভ সিক্সের ছেলেরা সহজপাঠঅভিনয় করে থার্মোকলের নিয়ে এক এক করে মঞ্চে ঢোকে আর নিজের নিজের ছড়াটা নেচে নেচে বলে দিয়ে যায় সবারটা শেষ হলে আবার একসাথে বলে অভিনয় করে কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি, ‘নাম তার মোতিবিল, ‘অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে, এই তিনটি ছড়া বেশ  সুন্দর পরিবেশনা সকলেই হাততালি দেয় এমনকী সামনের বেঞ্চে বসা সাইকেল চোর পুষ্করও

এবার রবীন্দ্রনাথের গান ,আবৃত্তি পরিবেশন করে ছাত্রছাত্রীরা অনুষ্ঠানের শেষের দিকে হেডস্যার পুষ্করের দিকে তাকিয়ে একটু অবজ্ঞার সুরে বলেন-‘তুই কিছু করবি নাকি?’

সবাই দেখে,পুষ্কর ঘাড় নাড়ছে–‘কী করবি?’ হেডস্যার বেজায় অবাক

-‘গান

-‘গান! রবীন্দ্রনাথের গান তুই জানিস?’

আবার ঘাড় নাড়ে পুষ্কর

-‘বেশ আয়হেডস্যার মাইকের সামনে ডেকে নেন পুষ্করকে

সুরঞ্জনস্যার সামনের বেঞ্চে বসে টিপ্পনি ছোড়েন-‘থানায় যাবার আগে প্রাণ খুলে গেয়ে নে 

প্রাণ খুলেই পুষ্কর গেয়ে ওঠে-‘আমরা সবাই রাজা,আমাদের এই রাজার রাজত্বে...।

চমৎকার মিষ্টি গলা আর একেবারে নিখুঁত সুর

গান শেষ হতে ছেলেরা হইহই করে ওঠে–‘আর একটা,আর একটা 

-‘আর জানিস?’ হেডস্যার পুষ্করের দিকে তাকান

পুষ্কর উত্তর দেয় না গেয়ে ওঠে-‘আয় তবে সহচরী,হাতে হাতে ধরিধরি

পুষ্করের গান শেষ হতে হেডস্যার অবাক হয়ে শুধোন-‘এসব কোথায় শিখলি?’

সামান্য একটা কথা এবারে টলে যায় ছেলেটা মার খেয়েও কাঁদেনি এবার কেঁদে ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বলে-‘স্কুলে পড়তাম,তখন শিখি ওই যে ছেলেরা অভিনয় করল বইটা,সেটা নিয়েই স্কুলে যেতাম  হঠাৎ মা মারা গেল ছমাসের মধ্যে বাবা কাকারা তাড়িয়ে দিল বাড়ি থেকে তারপর থেকেই একা

হেডস্যার রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দেন পুষ্করের চোখ তারপর মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে  ধরা গলায় বলেন-‘কী কান্ড! ছেলেরা আজ অভিনয় করল সহজপাঠ,আর এই দিনেই আমরা এমন একজনের দেখা পেলাম যার কাছে এই সহজপাঠের বড় দরকার! পুষ্কর বলছিল একা কিন্তু ওর পাশে আজ যদি আমরা না দাঁড়াই,তবে সহজপাঠের কবি আমাদের ক্ষমা করবেন না

ক্লাশ টুয়েলভের একটা বড় ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে-‘এমন গান যে গাইতে পারে তাকে আমরা আর স্টেশনে যেতে দেব নাথানাতে তো নয়ই

হেডস্যার বলেন-‘স্টেশনে যাবার কথা উঠছে কেন? আর থানাতে এই প্রায় দুধের শিশুকে তোরা বললেও আমি দিতাম না আর এখন তো ওসব ভাবাই অনুচিত পুষ্কর পড়বে,থাকবে স্কুলের হোস্টেলে সব দায়িত্ব  স্কুলের আর ওর বয়সোপযোগী ক্লাসে ভর্তি করার জন্য ওকে উপযুক্ত করে তোলার দায়িত্বটা না হয় আমিই নিলাম

হেডস্যারের কথাটা শুনে পুষ্কর আবার কেঁদে ফেলে তবে কান্না দুঃখের নয়,আনন্দের তাই হেডস্যার আর রুমাল নিয়ে এগিয়ে যান না  

 

 


৪টি মন্তব্য:

  1. একটা মন ভালো করা গল্প। একটা বেঁচে থাকার গল্প। স্বপ্নের চারাগাছ গুলোতে জল দিয়ে বড় করে তোলার গল্প।হারাতে বসা একটা দুঃস্বপ্নের রাত থেকে আলোয় উত্তোরণের গল্প। খুব ভালো লাগলো স্যার। সুন্দর শব্দ চয়ন।আর সংলাপ।

    উত্তরমুছুন
  2. সাহিন,তাহের দুজনকেই ধন্যবাদ।তাহের তো এ গল্পের কথা জানিস। কলকাতা বইমেলায় 'শিশু কিশোর গল্প প্রতিযোগিতায়' এটা দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছে এবার।

    উত্তরমুছুন